May 20, 2024
খেলাধুলা

৪৮-এ পা দিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের ‘সবচেয়ে সফল বোলার’

ভারতীয় ব্যাটিং কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার একবার বলেছিলেন, ‘যদি তোমার দিকে কেউ স্টোনস (পাথর) ছুড়ে মারে, তাহলে তুমি সেগুলোকে মাইলস্টোনে পরিণত করো।’ কথাটা লঙ্কান কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরনের ক্ষেত্রে ঠিকঠাক মিলে যায়।

আধুনিক ক্রিকেটে খুব কম খেলোয়াড়ই আছে যাকে মুরালিধরনের সমকক্ষ বলা যায়। ক্যারিয়ারে বহুবার বোলিং অ্যাকশনের জন্য প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। কটাক্ষের শিকার হয়েছেন। অসংখ্য সমালোচনা সয়ে একসময় ক্যান্ডি শহরে জন্ম নেওয়া এই স্পিনার নিজেকে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল বোলারে পরিণত করেছেন। এমনটা কয়জনের ক্ষেত্রে ঘটে?

একটা দৃশ্য বেশ ঝড় তুলেছিল। ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় বায়োমেকানিক্যাল বিশেষজ্ঞদের সামনে উদোম গায়ে বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা দিচ্ছেন মুরালি। গায়ে অসংখ্য সেন্সর লাগানো। ডজনখানেক ক্যামেরা তার দিকে তাক করা। সেই পরীক্ষায় পাস করেও শান্তিতে থাকতে পারেননি তিনি। এরপরও তাকে টিভি ক্যামেরার সামনে বল থ্রু করার আগে কনুইয়ের মাপ ঠিক আছে কি না সেই পরীক্ষা দিতে হয়েছে। হয়েছেন বর্ণবাদের শিকার। প্রতিপক্ষ দর্শকদের দুয়ো শুনতে হয়েছে অসংখ্যবার।

কিন্তু স্রোতের বিপরীতে নিজেকে শক্তপোক্ত মনের মানুষ হিসেবে ঠিকই প্রস্তুত করেছিলেন মুরালি। একসময় হয়ে উঠেছিলেন ব্যাটসম্যানদের ত্রাস। চোখের কোটর ঠিকরে প্রায় বেরিয়ে আসা তার দুটি অক্ষিগোলকের দিকে তাকালে সেরা ব্যাটসম্যানরাও ভয় পেয়ে যেতেন। কত ব্যাটসম্যান যে ওই ভয়েই ব্যাট হাতে খাবি খেয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। সেই সঙ্গে তার ভয়ঙ্কর স্পিন, যার কোনো তুলনা চলে না। বলের টার্ন বুঝে ওঠার আগেই ঘায়েল হয়েছেন অগণিত ব্যাটসম্যান।

একজন স্পিনার হয়েও যে সাফল্য মুরালিধরন অর্জন করেছেন তার কোনো তুলনা আদৌ চলে না। এত এত বিতর্ক আর সমালোচনা সয়েও টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে একমাত্র বোলার হিসেবে ৮০০ উইকেটের অবিশ্বাস্য মাইলফলকের মালিক হয়েছেন তিনি। ওয়ানডেতে তার উইকেটসংখ্যা ৫৩৪! দুই ফরম্যাটেই মাইলফলকের মালিক হওয়া চাট্টিখানি কথা! টেস্টে তার অর্জনকে একমাত্র ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ের অবিশ্বাস্য কীর্তির সঙ্গে তুলনা করা যায়।

শ্রীলঙ্কার সাবেক অধিনায়ক দুলীপ মেন্ডেস একবার বলেছিলেন, মুরালি কংক্রিটেও বল টার্ন করাতে সক্ষম এবং কথাটা একেবারেই মিথ্যে নয়। বাঁকানো কনুই আর শক্তিশালী কাঁধ ব্যবহার করে খুব সহজেই যেকোনো পিচেই বল ভয়ংকর স্পিন করাতে পারতেন তিনি। তার অধিকাংশ বলই ছিল ‘আনপ্লেয়েবল’। তবে এসব কারণেই তাকে বারবার বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে।

১৯৯৫ সালে মেলবোর্ন টেস্টে তাকে ৭ বার ‘নো বল’ ডেকে বসেন অস্ট্রেলিয়ার আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার। এর ঠিক ১০ দিন বাদে একটি ওয়ানডে ম্যাচেও তাকে বারবার ‘নো বল’ ডাকেন আম্পায়ার রস এমারসন। ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে অ্যাডিলেডে ফের এই এমারসনই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন। যখনই তিনি নতুন স্পেল শুরু করতে গেছেন, সঙ্গে সঙ্গে অজি দর্শকরা তাকে খেপাতে তারস্বরে ‘নো-বল’ বলে চিল্লাতে থাকে।

১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনার পর আদতে শ্রীলঙ্কার লাভই হয়েছিল। কারণ এরপর দলের সবাই মুরালির জন্য একজোট হয়ে খেলেছেন। আর এটার ফলও এসেছে এক বছর পরেই। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জিতেই সবকিছুর জবাব দিয়েছে শ্রীলঙ্কা।পরে মুরালিকে ‘নো-বল’ ডাকার ওই ঘটনা বিশ্বকাপ জেতায় কত বড় ভূমিকা রেখেছিল তা নিজেই জানিয়েছেন আরেক কিংবদন্তি কুমার সাঙ্গাকারা।

উইজডেন ম্যাগাজিনকে সাঙ্গাকারা বলেন, “আমার মনে হয়, মুরালির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ওই নো-বল কাণ্ডই আমাদের বিশ্বকাপজয়ী দলে পরিণত করেছিল। ওই ঘটনাই শ্রীলঙ্কা দলকে ‘আমাদের দল’ বানিয়েছিল এবং মুরালি ‘আমাদের মুরালি’ হয়ে আমাদের একটা লক্ষ্য দিয়েছিল। আমরা এখন জানি কীভাবে এলিটদের হারাতে হয়, আমাদের শুধু বিশ্বাস থাকতে হবে। আর মুরালি আমাদের সেই বিশ্বাস জুগিয়েছিল।’

মুরালির কারণেই আইসিসি’র গভর্নিং কাউন্সিল বোলারদের জন্য  ১৫ ডিগ্রি পর্যন্ত কনুই বাঁকানোর নিয়ম বানাতে বাধ্য হয়। তারা এটাও স্বীকার করে যে, মুরালির অ্যাকশনের ধরন একধরনের ‘ভ্রম’ তৈরি করে। ২০০২ সালে অজি লেগ স্পিন কিংবদন্তি শেন ওয়ার্নকে ছাড়িয়ে উইজডেন কর্তৃক ইতিহাসের সেরা বোলারের খেতাবে ভূষিত হন মুরালি।

বোলিং অ্যাকশনের সময় ভয়ানক হয়ে ওঠা মুরালি কিন্তু আদতে অত্যন্ত হাসিখুশি একজন মানুষ। তার মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। তবে তার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা কিন্তু অন্যখানে। দলের একমাত্র তামিল খেলোয়াড় হয়েও জাতিগত বিদ্বেষে আক্রান্ত একটা দেশের ‘একতাবদ্ধ শক্তির’ প্রতীক তিনি। আজ এই জীবন্ত কিংবদন্তির ৪৮তম জন্মদিন।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *