May 3, 2024
ফিচারলেটেস্ট

বাংলাদেশে কাজুবাদাম চাষের সমস্যা ও সম্ভাবনা

জাকিয়া সুলতানা, মো: আব্দুল মান্নান, মো: মতিউল ইসলাম ও মো: মনিরুল ইসলাম

কাজু: ভূমিকা ও পরিচিতি

কাজুবাদাম গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Anacardium occidentale। এটি Anacardiaceae পরিবারের অন্তর্গত। আদতে, কাজু দক্ষিণ এবং মধ্য আমেরিকার আদিবাসী এবং ১৫ শতকে এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে। এটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ, বিশেষ করে, উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে এখন অনেকটা আঞ্চলিক হয়ে উঠেছে। সুতরাং, যদি সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাহলে ধারণা যায় যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল কাজু চাষের এক অপার সম্ভাবনাময় অঞ্চলে পরিণত হতে পারে। উল্লেখ্য, একদিকে যেমন কাজুবাদামের স্বাদ মনোরম, অপরদিকে পুষ্টিগুণে এটি সুষম। একশ গ্রাম কাজুর বাদামে প্রায় ৫৫৩ কিলোক্যালরি শক্তি থাকে। কাজুবাদামে পুষ্টির মান এরকম: প্রোটিন (২১%), চর্বি (৪৭%), কার্বোহাইড্রেট (২২%) এবং এতে সমস্ত চর্বি-দ্রবণীয় ভিটামিন (A, D, E এবং K) রয়েছে, যা শরীরবৃত্তে আত্তীকরণে খুবই সহায়ক।

স্বাস্থগত দিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহার

কাজু দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কাজুতে পাওয়া মোট চর্বির প্রায় ৮২% হল একটি অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড। কাজু রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এটি ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, আয়রন এবং অন্যান্য খনিজের একটি উৎস। এছাড়া, কাজু অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের একটি ভাল উৎসও বটে। কাজু মিষ্টান্ন শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বর্তমানে। এটি কেক, মিষ্টি, উদ্ভিজ্জ খাবার এবং চকোলেটের স্বাদের জন্য ব্যবহৃত হয়। কাজুর শাসে ৪০% তেল রয়েছে, যা বাদামের মতো।

কাজু চাষের উপযুক্ত পরিবেশ

কাজু একটি দ্রুত বর্ধনশীল চিরহরিৎ গাছ এবং এটি লবণ ও খরা সহনশীল পরিবেশে ভালভাবে জন্মাতে পারে। এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় জন্মানোর জন্য খুবই উপযুক্ত। উপকূলীয় বালুকাময় এবং লাল ল্যাটেরিটিক মাটি থেকে শুরু করে সমতল ভূমিসহ ভাল উর্বরতা আছে এমন যেকোনো মাটিতে এটি ভাল জন্মে। লাল বেলে দোআঁশ মাটিসহ প্রায় সব মাটিতেই কাজু চাষ করা যায়। আগে এটি মনে করা হতো কিন্তু এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, কাজু একটি বর্জ্য জমির ফসল। এটি চাষে খুব বেশি যত্নের প্রয়োজন নেই। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কাজু পানি এবং বায়ু তাড়িত ক্ষয় থেকে মাটিকে রক্ষা করতে পারে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে কাজু চাষের সম্ভাব্যতা এবং উপযুক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

কাজুর বৈশ্বিক উৎপত্তি ও বিকাশ

এশিয়া ও আমেরিকার অনেক দেশে কাজু একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী হিসেবে পরিগণিত। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজুর একটি ক্রমবর্ধমান বাজার রয়েছে। এখন রাশিয়া এবং জাপানের মতো বিশ্বের অন্যান্য অংশেও এর একটি নতুন বাজার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দিন দিন বিশ্ববাজারে কাজু ও এর উপজাতের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অসামান্য হাতিয়ার হতে পারে কাজু।  একটু গুরুত্ব পেলেই কাজু হতে পারে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজাত পণ্য। অনুকূল কৃষি-জলবায়ু, অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং রপ্তানির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে কাজু চাষকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে উদ্যোগের অভাব দেখা যায়। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন ও Bangladesh Agricultural Research Council এর উদ্যোগে পরিচালিত একটি গবেষণার তথ্য হতে জানা যায়, বাংলাদেশে কাজু চাষের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা রয়েছে ।

অর্থকরি ফসল হিসেবে কাজু

কাজু একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং লাভজনক ফল ফসল যা বাংলাদেশে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। যদিও বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে কাজু চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেটি এখনও আনুষ্ঠানিক গবেষণা পদ্ধতির দ্বারা মূল্যায়ন করা হয়নি, যা অচিরেই করা দরকার। এখানে কাজু চাষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গভীরভাবে তদন্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশে কাজুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৫০,০০০ টন। আমরা বর্তমান প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে আমদানির উপর নির্ভর করে থাকি। অনতিবিলম্বে তাই বাংলাদেশে কাজু চাষ সম্প্রসারণ করতে হবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলগুলি কাজু চাষের একটি ক্রমবর্ধমান কেন্দ্র হতে পারে। কারণ কাজু লবন সহ্য করতে পারে এবং লবণাক্ততাযুক্ত মাটিতে জন্মাতে পারে। উল্লেখ্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিন এই অঞ্চলে কাজুর ভবিষ্যৎ উৎপাদন সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে প্রয়োজনীয় গবেষণার লক্ষ্যে এরই মধ্যে কাজুবাদাম গাছের একটি জার্মপ্লাজম পুল তৈরি করেছে। গবেষণকগণ মনে করেন, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও কাজু চাষের বর্তমান অবস্থার খুটিনাটি গভীরভাবে জানা প্রয়োজন।

কাজুর আয় সম্ভাবনা

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে, প্রায় ১৩২৩ টন কাজু উৎপাদিত হয়েছে, যা এক বছরের আগের তুলনায় ৩২.৩% বেশি। স্থানীয় বাজারে মানের উপর নির্ভর করে এক কেজি কাজুবাদাম ৮০০/- টাকা (৯.৩৪ ইউএস ডলার) থেকে ১৭০০ অর্থাৎ ১.৮৪ ইউএস ডলারের মধ্যে বিক্রি হয়। তাই, স্থানীয় বাজারে গ্রিন গ্রেইন কাজু বাদামের উচ্চ মূল্য থাকায়, পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় ২০০০ কৃষক বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে কাজু চাষে নিযুক্ত রয়েছেন। বাংলাদেশের একমাত্র প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দুবাইতে ১৬ টন প্রক্রিয়াজাত কাজুবাদাম সরবরাহ করার অর্ডার পেয়েছে। বাংলাদেশী কাজুবাদাম ভারতীয় বা ভিয়েতনাম জাতটির তুলনায় বেশী সুস্বাদু। একবার বাংলাদেশের এক ব্যবসায়ী ইংল্যান্ডে তার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের জন্য ৫০০ কেজি কাজুবাদাম অর্ডার করেছিলেন।

দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় কাজু চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে

কাজু একটি দ্রুত বর্ধনশীল চিরহরিৎ গাছ এবং এটি লবণ ও খরা সহনশীল। তাই বাংলাদেশের উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকা কাজু চাষের উপযোগী এক জমিন। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রভূত সম্ভাবনা থাকায় কাজু হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ একটি কৃষিজাত পণ্য। অনুকূল কৃষি-জলবায়ু, অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং রপ্তানির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশে কাজু চাষকে জনপ্রিয় করার কোনো উদ্যোগ এখনও নেয়া হয়েনি। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলগুলি শীঘ্রই একটি ক্রমবর্ধমান কেন্দ্র হতে পারে কারণ কাজু লবন সহ্য করতে পারে এবং লবণাক্ততাযুক্ত মাটিতে জন্মাতে পারে। ভারতের উপকূলীয় অর্থনীতিতে কৃষির একটি প্রভাবশালী ভূমিকা রয়েছে। সেদেশের কিছু রাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চল যেমন কর্ণাটক, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, এবং ঝাড়খন্ড এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির মতো অপ্রচলিত অঞ্চলগুলিতেও বর্তমানে একটি উদ্যান ফসল হিসাবে কাজু চাষ গুরুত্ব পাচেছ। সেখানকার অসংখ্য মানুষ এই চাষে অগ্রসর হচ্ছে৷ ছত্তিশগড়ের বস্তার অঞ্চলে, কাজু চাষ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রধান ফসল হিসাবে গুরুত্ব পেয়েছে। আবার আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চল জুড়ে ৪৬ টি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বেশিরভাগই কাজুবাদামের প্রধান উৎপাদন অঞ্চল। গবেষণা এলাকায় দেখা গেছে, কাজু চাষের অবস্থা ভাল নয়। অধিকাংশ কৃষকের (৬৫%) মালিকানাধীন মাঝারি আকারের খামার, এবং চাষকৃত কাজু জাতগুলি স্থানীয় (৮৯%) ছিল। কাজুর ফলন মাঝারি ছিল (১.৪০ থেকে ১.৮০ হেক্টর), একটি পৃথক গাছের ফলন ৩ থেকে ৮ কেজি পর্যন্ত। দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি (৬৮.৩%) কৃষক কাজু চাষ থেকে ১২০০০০-১৮০০০০ টাকা আয় করেছেন। এখনও গড়ে ০.৮৯ হেক্টর জমি কাজু চাষের আওতায় নেওয়া যেতে পারে। কাজু চাষ থেকে ৮,৩৪২.৪২ – ৯,৭০৬.৬৯ ইউএস ডলার সমতুল্য নিট লাভের সম্ভাবনা রয়েছে, যা অন্যান্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি। এটি প্রমাণ করে যে কাজু চাষের সম্ভাবনা উচ্চ অর্থনৈতিক সম্ভাবনার। মাঝারি সমস্যায় পড়েছেন কৃষকরা। বাদাম এবং আপেলের জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাব ছিল অত্যন্ত গুরুতর সমস্যা, তারপরে মানসম্পন্ন বীজ বা চারাগুলির অভাব ছিল। উত্তরদাতাদের ১৯ টি নির্বাচিত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে, শিক্ষা, বার্ষিক আয়, কৃষি থেকে আয়, খামারের আকার, কাজুর জন্য উপযুক্ত জমি, কাজুর চাষের জমি, কাজুর জাত, কাজু গাছের সংখ্যা, ফলের গাছ, গাছ প্রতি মোট উৎপাদন এবং মনোভাব উল্লেখযোগ্য ছিল।

উপসংহার

বাংলাদেশে কাজু চাষের চমৎকার সুযোগ রয়েছে। সরকার যদি কাজুর সঠিক বাজারমূল্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়, প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র বা শিল্পের উন্নতিবিধান করে ও সঠিক বিপণন চ্যানেলের ব্যবস্থা করে, তাহলে অচিরেই কাজু হবে বাংলাদেশের জন্য একটি অপরিহার্য অর্থকরী ফসল। অতএব, সরকারকে কাজু চাষ সম্পর্কে আরো বেশী উদ্যোগী হতে হবে এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় জ্ঞান বৃদ্ধি, জ্ঞানের গ্রহণ এবং বিতরণে উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি, আমরা মনে করি এ বিষয়ে বেসরকারী উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত। তাহলে দেশ ও দশের তাতে মঙ্গল হবে।

শেয়ার করুন: