April 16, 2024
জাতীয়লেটেস্ট

ঢাবি ছাত্রীর ধর্ষক মজনু গ্রেফতার

মজনু একজন সিরিয়াল রেপিস্ট ও মাদকাসক্ত

ছবি দেখে সনাক্ত করেছে ওই ছাত্রী : র‌্যাব

 

দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক

ঢাকার কুর্মিটোলায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার যুবক এর আগেও ‘বহু নারীকে ধর্ষণ করেছে’ বলে জানিয়েছে র‌্যাব। গতকাল বুধবার দুপুরে কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, মজনু নামের আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী ওই যুবক ‘মাদকাসক্ত; এবং একজন ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’।

র‌্যাব বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের কথাও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন মজনু। তার ছবি দেখানোর পর মেয়েটিও তাকে শনাক্ত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্রী শেওড়ায় বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার পথে ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কুর্মিটোলায় বাস থেকে নামার পরপরই আক্রান্ত হন। পেছন থেকে মুখ চেপে ধরে তাকে তুলে সড়কের পাশে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় তিন ঘণ্টা ধরে।

কয়েক ঘণ্টা পর চেতনা ফিরে পেয়ে ওই ছাত্রী বান্ধবীর বাসায় যান। রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়। পরদিন ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন তার বাবা।

সহপাঠী ধর্ষিত হওয়ার খবরে সেই রাত থেকেই ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মামলা তদন্তের দায়িত্ব গোয়েন্দা পুলিশকে দেওয়া হলেও র‌্যাবসহ পুলিশের অন্যান্য বিভাগ তদন্তে নামে।

র‌্যাব বলছে, ওই ছাত্রীর মোবাইল ফোন ও ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিল ধর্ষক, যার সূত্র ধরে মঙ্গলবার দুইজনকে আটক করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার ভোর পৌনে ৫টায় শেওড়া রেলের ক্রসিং এলাকা থেকে মজনুকে র‌্যাব গ্রেফতার করে। তার কাছ থেকে ধর্ষণের শিকার শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোন, ব্যাগ ও পাওয়ার ব্যাংক উদ্ধার করার কথাও জানানো হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে।

এরপর বুধবার দুপুরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মজনুকে নেওয়া হয় কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে। সেখানে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে মজনুর বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেন সারোয়ার বিন কাশেম।

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মজনুর বয়স আনুমানিক ৩০ বছর, বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। জীবিকার তাগিদে  বছর দশেক আগে তিনি ঢাকা আসেন। মজনুর বাবা মাহফুজুর রহমান মারা গেছেন আগেই। মা জীবিত থাকলেও বাড়ির সঙ্গে মজনুর কোনো  যোগাযাগ নেই।

নিরক্ষর মজনু ১২ বছর আগে ট্রেনে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলেন। এই ভাঙা দাঁতের বিষয়টি তদন্তের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বলে জানান সারোয়ার বিন কাশেম।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সে (মজনু) একসময় বিবাহিত ছিল। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মজনু বলেছেন, তিনি পেশায় দিনমজুর, হকার। পাশাপাশি তিনি ‘ছিনতাই, রাহাজানি, চুরির মত কাজেও’ জড়িত ছিলেন বলে র‌্যাবের ভাষ্য। সে আমাদের কাছে প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়েছে, সে সিরিয়াল রেপিস্ট। সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক মহিলাকেও নানাভাবে ধর্ষণ করেছে। সে মাদকাসক্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষার্থীর বক্তব্য এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মজনুর দেওয়ার তথ্যের ভিত্তিতে সেদিন সন্ধ্যার ঘটনাপ্রবাহের একটি বিবরণ সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক।

তিনি বলেন, আমাদের ভিকটিম কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নামে তার বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার জন্য। সে পথ ভুল করে সেখানে নামে। পরবর্তীতে সে যখন নির্জন পথ দিয়ে যাচ্ছিল, মজনু তাকে ফলো করতে করতে তার গলায় চাপ দিয়ে জাপটে ধরে একটি ঝোপের আড়ালে নিয়ে যায়। সেখানে সে ধর্ষণের মত বর্বরোচিত করমটি সম্পাদন করে।

ওই মুহুর্তগুলোতে সে বারবারই তাকে (ভিকটিম) ঘুষি দিচ্ছিল, চড় দিচ্ছিল এবং গলা চেপে হত্যার হুমকি দিচ্ছিল। স্বভাবতই ভিকটিম এ ঘটনায় পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে বেশ কয়েকবার অচেতন হয়ে পড়ে। তার যখন চেতনা ফিরে আসে, তখন সে সুযোগ বুঝে মজনুর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, সেই রাতে মেয়েটির ফেলে যাওয়া মোবাইল ফোন, ব্যাগ এবং পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন মজনু। কুর্মিটোলায় অরুণা নামে পরিচিত এক নারীর কাছে ফোনটি বিক্রি করে দেন ৫০০ টাকায়। তবে অরুনা তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ৪০০ টাকা দিয়ে, বাকি টাকা পরে দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দেন।

সেখান থেকে মজনু প্রথমে যান বিমানবন্দর স্টেশনে। ওই রাত তিনি নরসিংদীতে কাটান। পরে অরুণার কাছে বাকি ১০০ টাকা নিতে ঢাকায় আসেন। মঙ্গলবার সারাদিন তিনি ছিলেন বনানী স্টেশনে। এরপর বুধবার ভোরে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এটা একটা ক্লুলেস অপারেশন ছিল, আমাদের কাছে কোনো সিটিটিভি ফুটেজ ছিল না। কোনো তথ্য ছিল না। জাস্ট কিছু বর্ণনার সূত্র ধরে আমরা তদন্ত করেছি।

র‌্যাব কর্মকর্তা কাশেম বলেন, ভিকটিমের মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে তারা খায়রুল নামে এক রিকশাচালককে আটক করেন। খায়রুল ওই মোবাইল কিনেছিলেন অরুণার কাছ থেকে। পরে খায়রুলের দেওয়া তথ্যে অরুণাকেও আটক করা হয়।

অরুণার দেওয়া তথ্যের সঙ্গে ভিকটিমের তথ্য মিলিয়ে আমরা সিদ্ধান্তে আসি যে তারা (মোবাইল বিক্রেতা  ও ধর্ষক) একই ব্যক্তি। কারণ তার বাড়ি নোয়াখালী, স্থানীয় ভাষায় সে কথা বলে, তার সামনে দাঁত নেই। চুল কোঁকড়া এবং সে খর্বকায়। এই তথ্যগুলো মিলিয়ে আমরা তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই।

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মজনু বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের সময় তিনি একাই ছিলেন।  আর ভিকটিমও তার বিবরণে একজনের কথাই বলেছেন।

সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, আমরা ভিকটিমকে ছবি দেখিয়ে কনফার্ম করেছি,  যে এই সেই ব্যক্তি। বেশ কয়েকবারই তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে কথা বলেছি। সে বার বার আমাকে একটা কথাই বলেছে, আমি পৃথিবীর সমস্ত চেহারা ভুলে যেতে পারি, এই লোককে আমি কখনো ভুলব না।

কীভাবে মজনু ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’ হয়ে উঠলেন, সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা কাশেম বলেন, তার স্ত্রী যখন মারা যায়, তারপর আসলে তার যা অবস্থা, সে আর কাউকে বিয়ে করতে পারেনি। তখন যেটা সে করত, বিভিন্ন ভিক্ষুক, তাদের সে ধর্ষণ করত।  এবং প্রতিবন্ধী নারী, তাদের সে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে রাখত এবং এই কাজগুলো করত।

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, মজনু সেদিন কুর্মিটোলা হাসপাতালে গিয়েছিলেন প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর একটি মেয়েকে নির্জন ফুটপাতে একা ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে দেখে তিনি অনুসরণ শুরু করেন।

সে ওঁৎ পেতে ছিল যে কেউ যদি আসে এই কাজ করবে। যেখানে সে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা ঝোপের আড়ালে। প্রথমে আমরাও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম এই রকম একটা জায়গায় সে কীভাবে এতক্ষণ এটা করল, প্রায় তিন ঘণ্টা।

সেখানে ওই সময় মানুষের চলাচল সীমিত থাকে। সে কারণে সে দীর্ঘক্ষণ ধরে এই অপকর্মগুলো করতে পেরেছিল। আগেও সে একই জায়গায় এরকম অপকর্ম করেছে। আরেক প্রশ্নে কাশেম বলেন, মজনুর মধ্যে কোনো ধরনের অনুশোচনার ভাব তারা দেখেননি।

সে পুরোপুরি নির্বিকার। ধরা পড়ে প্রথমেই সে এগুলো স্বীকার করে নেয়। সে যে কয়েকবার (সেই ঢাবি শিক্ষার্থীকে) হত্যার চেষ্টা করেছিল, এটাও সে অকপটে স্বীকার করেছে। এটা নিয়ে যে দেশজুড়ে তোলপাড় হচ্ছে, এ বিষয়ে সে অবগত ছিল না।

 

 

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *