May 17, 2024
আন্তর্জাতিক

ট্রাম্পকে খুশি করতে জিনপিংকে খুঁচিয়ে বিপাকে ব্রিটেন

‘ডিভোর্সের’ পর জীবনযাপন অনেক সময় কঠিনও হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ৪৭ বছরের বন্ধন ছিন্ন করে চীনের সঙ্গে গড়া ব্রিটেনের নতুন সম্পর্ক এখন গভীর জলে। ব্রেক্সিটে সফল হতে তাদের চীনের বিশাল অর্থনৈতিক শক্তির দরকার ছিল। কিন্তু, সেই সম্পর্ক এখন তেতো হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশীরা খুশি নয়, সম্পর্কের উজ্জ্বলতাও আর আগের মতো নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের চাপে এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘নতুন স্নায়ুযুদ্ধ’ কৌশলে পড়ে বরিস জনসন চীনের সঙ্গে দ্বিচারিতা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। হয়তো দুই পক্ষকেই সামলানোর উপায় ছিল। তবে জনসন জানতেন, একটু অবাধ্য হলেই তার আরেকটি ব্রেক্সিট অঙ্গীকারের সম্ভাবনা মিলিয়ে যেতে পারে- যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি।

তাহলে কী করা যায়? ত্রিমুখী সম্পর্কের মধ্যে পড়ে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা চীনা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেই খুশি করার পথ বেছে নেন। তবে ব্রিটিশ সংবামাধ্যম দ্য অবজার্ভারের প্রতিবেদন অনুসারে, ব্রিটেন হয়তো গোপনে হুয়াওয়েকে জানিয়েছে, এগুলো করতে হচ্ছে ভূরাজনৈতিক কারণে এবং সিদ্ধান্তগুলো হয়তো প্রত্যাহার করা যাবে।

অর্থাৎ, ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া পুরস্কার কুড়াচ্ছে, আবার চীনকে কানে কানে বলছে, ট্রাম্পই হচ্ছে মূল সমস্যা; জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে জো বাইডেন বসলে পরিস্থিতি অনেকটাই নমনীয় হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যও হয়তো আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

ভূরাজনীতি আসলেই একটা জটিল বিষয়। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জোট ও আইন সম্পর্কে ট্রাম্পের অবজ্ঞায় যুক্তরাজ্যের ঐতিহ্যবাহী আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবলভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এটি মার্কিন নির্ভরযোগ্যতাকে সন্দেহের মধ্যে ফেলেছে এবং ব্রিটেনের ভূরাজনৈতিক ভিত্তিকে কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

একই সময় শি জিনপিং পূর্বসূরিদের ‘শান্তিপূর্ণ উত্থানের’ নীতি থেকে চীনকে সরিয়ে নিচ্ছেন। এর পরিবর্তে তিনি একটি সম্প্রসারণবাদী ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গি প্রদর্শন করছেন। চীনা প্রেসিডেন্ট এধরনের ব্যবস্থা হয়তো আরও পরে নিতে পারতেন। কিন্তু দেখা যায়, ২০১৭ সালে ট্রাম্প চীনকে ‘কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘অর্থনৈতিক আগ্রাসী’ ঘোষণার পর থেকেই তার পদক্ষেপ দ্রুততর হয়েছে।

সম্প্রতি হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন ইস্যু এবং হুয়াওয়ে বয়কটে মিত্রদের ওপর মার্কিন চাপে এই ভূ-রাজনৈতিক ঝড়ের কেন্দ্রে পড়ে ডুবতে বসেছে ব্রিটেন। এ থেকে উত্তরণের উপায় আছে কি?

আছে, ব্রিটেনের সব আশা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। কারণ, ভূরাজনৈতিক হিসাব ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। তাছাড়া, হুয়াওয়ে ও হংকং ইস্যুতে ইইউ’র সদস্য থাকলেও ব্রিটেনের খুব একটা লাভ হতো না।

আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে চীনের বিরুদ্ধে বেলজিয়াম কিছুটা মুখ খুললেও বেইজিংয়ের বাঁধন থেকে পালিয়ে আসা হংকংয়ের নাগরিকদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্রিটেনের সঙ্গে যোগ দেয়নি ইইউ’র সদস্য কোনও দেশই।

আর হুয়াওয়ের দিক থেকে দেখলে, ইউরোপের অনেক দেশের সঙ্গেই তাদের চুক্তি রয়েছে। কিছু কিছু দেশ অবশ্য জার্মানির দিকে তাকিয়ে রয়েছে যে, তারা আগামী সেপ্টেম্বরে হুয়াওয়ে নিয়ে কী পদক্ষেপ নেয়। তবে সেখান থেকেও হুয়াওয়ের জন্য নেতিবাচক কোনও খবর আসার সম্ভাবনা কম। যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের মতো চীনা প্রতিষ্ঠানটিকে দূর করার চিন্তা নেই জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেলের। বরং, তিনি চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতেই বেশি আগ্রহী।

এছাড়া, ইইউ’র অনেক দেশও চীনের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখার পক্ষে। ইতালি গতবছর চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দিয়েছে, চীনা পণ্য রপ্তানিতে নিজেদের ইউরোপের প্রবেশদ্বার বলে প্রচার করছে গ্রিস, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ট্রাম্পের বদলে যে কাউকেই পছন্দ করেন, এমনকি ভ্লাদিমির পুতিনকেও।

এছাড়া, ব্রিটেন কূটনৈতিক পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসলে সেটাও চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের গতিপথ বদলে দিতে পারে। শি জিনপিং অতুলনীয় শক্তিপ্রদর্শন করতে গিয়ে ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে গেছেন- এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করা যেতে পারে। এই লড়াইয়ের একটা অংশ হতে পারে করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে চীনের প্রতি ট্রাম্পের অভিযোগ। অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি, জিম্মি করা নিয়ে কানাডার অভিযোগ, সীমান্তে ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষ, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের সামুদ্রিক অধিকার ভঙ্গের অভিযোগ, হংকং এবং তাইওয়ান ইস্যুতেও সারাবিশ্বে ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চীনের।

ফলে মহামারিতে অর্থনৈতিক ধাক্কা, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তি স্থগিত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিশ্বের নিন্দার মুখে জিনপিং যে কিছুটা হলেও পিছু হটেছেন, তা কল্পনা করা কঠিন নয়। এগুলো থেকেও লাভের উপায় খুঁজতে পারে ব্রিটেন।
এছাড়া, নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন জিতলে ওয়াশিংটনের আগ্রাসী চরিত্রটা বদলে যাওয়াও অসম্ভব নয়। তিনি পাকা রাজনীতিবিদ, কয়েক দশক ধরে সিনেটর ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব সামলে হাত পাকিয়েছেন। এ ডেমোক্রেট নেতা চীনকেও বেশ ভালোভাবে বোঝেন। ফলে তিনি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসলে রাতারাতি সেখানকার ভূরাজনৈতিক আবহাওয়া বদলে যাওয়া অসম্ভব নয় বলেই মনে করা হচ্ছে।

নতুন প্রেসিডেন্ট আসলেও হয়তো বেইজিংয়ের সঙ্গে উত্তেজনা থাকবে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের আবহ অন্তত সামলে উঠবে দ্রুত। ভূরাজনৈতিক খেলার পাকা খেলোয়াড় বাইডেন জানেন কীভাবে জিততে হয়। বরিস জনসন তার কাছ থেকে অন্তত এই বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারেন।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *