April 16, 2024
জাতীয়লেটেস্ট

গুজব ছড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা: বুড়িমারীতে আরও ২ জন গ্রেফতার

লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে গণপিটুনি দিয়ে আবু ইউনুস মো. সাহিদুন্নবী জুয়েলকে হত্যার পর মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলায় আরও দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার ৩৮ জন।

সোমবার (২৩ নভেম্বর) সকালে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক।

গ্রেফতার দু’জন হলেন- লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর ইউনিয়নের আউলিয়ারহাট কামাতপাড়া এলাকার শহিদুল ইসলামের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক বাবলা (২৬) ও একই উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের উফারমারা সোনারভিটা এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে জিএম মানিক (৪৫)।

ওসি ওমর ফারুক বলেন, বহুল আলোচিত সাহিদুন্নবী জুয়েল হত্যায় দায়ের করা পুলিশের ওপর হামলা ও ইউপি ভবনে হামলার মামলায় অজ্ঞাত নামীয় আসামি বাবলা ও মানিককে রোববার (২২ নভেম্বর) রাতে বুড়িমারী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। দুইটি মামলায় তদন্তে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এ নিয়ে মোট ৩৮ জনকে গ্রেফতার করা হলো। যার মধ্যে ১৩ জনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ। আবু কালাম ওরফে গামছা কামাল নামে আরও এক জনের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি বুধবার (২৫ নভেম্বর) দিনধার্য করেছেন আদালত। এর মধ্যে মূলহোতা বুড়িমারী ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল হোসেন ওরফে হোসেন ডেকোরেটর এবং মসজিদের খাদেম জোবেদ আলীসহ চারজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এর আগে গত ২৯ অক্টোবর বিকেলে পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক সাহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক ছাত্র ছিলেন। গত বছর চাকরিচ্যুত হওয়ায় কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, সাহিদুন্নবী জুয়েল ২৯ অক্টোবর বিকেলে যোবাইয়ের আব্দার নামে এক জনকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমারী বেড়াতে আসেন। বিকেলে বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন তারা। নামাজ শেষে পাঠ করার জন্য মসজিদের সানসেটে রাখা কোরআন শরিফ নামাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত কয়েকটি কোরআন ও হাদিসের বই তার পায়ে ওপর পড়ে যায়। সে সময় কোরআর ও হাদিস বই তুলে চুম্বনও করেন জুয়েল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে মুয়াজ্জিনের কথা কাটাকাটি হয়। এরপর আশপাশের লোকজন ছুটে এসে সন্দেহবশত জুয়েল ও সুলতান রুবায়াত সুমনকে পাশে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবনের একটি কক্ষে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ওসি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে যান।

সন্ধ্যায় পুরো বাজারে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, কোরআন অবমাননার দায়ে দুই যুবককে আটক করা হয়েছে। সে সময় উত্তেজিত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দরজা-জানালা ভেঙে প্রশাসনের কাছ থেকে জুয়েলকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পাটগ্রাম বুড়িমারী মহাসড়কে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় স্থানীয়রা। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।

সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা থানা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সে সময় বিক্ষুব্ধ জনতার ছোড়া ইট পাথরের আঘাতে পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন্ত কুমার মোহন্তসহ ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ১৭ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। রাত সাড়ে ১০টার দিকে লালমনিরহাটের ডিসি আবু জাফর ও এসপি আবিদা সুলতানা অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। নিহত জুয়েলের সঙ্গী যোবাইয়েরকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।

ঘটনাটি তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত ৩০ অক্টোবর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিএমএ মমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন।

এ ঘটনায় নিহত জুয়েলের চাচাত ভাই সাইফুল আলম, পাটগ্রাম থানার এসআই শাহজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বাদী হয়ে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলের ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করে অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৮ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার সবাই বুড়িমারী এলাকার বাসিন্দা বলে জানায় পুলিশ।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার কোনো সত্যতা পাননি। গুজব ছড়িয়ে জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা ও পরে মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলেও দাবি করেন তারা।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *