April 26, 2024
আঞ্চলিকলেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

খুলনা অঞ্চলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি, বাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ এলাকা ও চিংড়ি ঘের প্লাবিত

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাব

দ. প্রতিবেদক
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাব ও চলমান পূর্ণিমার কারণে খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকার দুর্বল বাঁধ ভেঙে এবং উপচে পড়ে বিভিন্ন এলাকা, চিংড়ি ঘের প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। একই সাথে জোয়ারের পানি বৃদ্ধির কারণে গুরুত্বপূর্ণ বাঁধগুলো চরম হুমকির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ না থাকায় যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
আমাদের পাইকগাছা প্রতিনিধি আবুল হাশেম জানান, পাইকগাছায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে ওয়াপদার দূর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গতকাল বুধবার বেলা ১১/১২টার দিকে ভরা পূর্ণিমার জোয়ারে অসংখ্য স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এ ছাড়া বাঁধ উপচে বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। ওয়াপদার বাইরের বেশিরভাগ চিংড়ি ঘের এবং ভিতরের অসংখ্য ঘের তলিয়ে কোটি কোটি টাকার মৎস্য ভেসে যায়। বিনষ্ট হয় কৃষি ফসলসহ ঘর-বাড়ী ও রাস্তা ঘাট। সোলাদানা বাজার ও পৌর বাজার তলিয়ে গিয়ে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তি হয়। জনপ্রতিনিধি, আনসার, প্রকল্প শ্রমিক, স্বেচ্ছাসেবক সহ এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতের কাজ করেছে। বাঁধ মেরামত সহ ক্ষয়ক্ষতি নিরপন ও ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার দিনভর এলাকায় দমকা হাওয়া সহ বৃষ্টিপাত হয়। বুধবার দুপুরের দিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এলাকার নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট পানি বৃদ্ধি পায়। এর ফলে জোয়ারের অতিরিক্ত পানিতে বিভিন্ন এলাকার বাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।
মেয়র সেলিম জাহাঙ্গীর জানান, শহর রক্ষা বাঁধ উপচে পৌর বাজারের কয়েকটি মার্কেটের সড়ক তলিয়ে গিয়ে পৌরভবন পর্যন্ত পানি চলে আসে।
স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, হরিঢালী ইউনিয়নের মাহমুদকাটীর মালোপাড়া, কপিলমুনি ইউনিয়নের আগড়ঘাটা বাজার সংলগ্ন পদ্মপুকুর এলাকা, লতা ইউনিয়নের পশ্চিম লতা, ধলাই গেট, দেলুটি ইউনিয়নের জকারহুলা, মধুখালী, চকরি-বকরি মুনকিয়া-দিঘলিয়া ও দেলুটির পূর্বপাশ, সোলাদানা ইউনিয়নের সোলাদানা বাজার, ভাঙ্গাড়িয়া, পাটকেলপোতা স্লুইচ গেট, হরিখালী, পারিশামারী, নুনিয়াপাড়া, সোলাদানা, পতন, বেতবুনিয়া ও হরিখালী আবাসন, লস্কর ইউনিয়নের আলমতলা হাটের ওপারে, কড়ুলিয়া আনিচের ঘের হতে শাহআলম মেম্বরের বাড়ী পর্যন্ত, বাইনতলা, লস্কর উত্তর ওয়াপদা, পশ্চিম বিলের মান্নানের গেট, কড়ুলিয়া বিশুর বাড়ী হতে শিববাটী ব্রীজ পর্যন্ত এবং স্মরণখালীর ত্রিনাথ বাছাড়ের বাড়ীর সামনের গেট ও ভড়েঙ্গা গেট ভেঙ্গে এবং বাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। রাড়ুলী ইউনিয়নের তোড়াডাঙ্গা ও ভড়বুড়িয়া এবং মালোপাড়া, গড়ইখালী ইউনিয়নের আবাসন সহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস জানান, প্লাবিত এলাকার বিভিন্ন ইউনিয়নের আশ্রয় কেন্দ্রে অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের পক্ষ থেকে আশ্রয় নেওয়া এসব মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস মোকাবিলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে ছিলাম। স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আক্তারুজ্জামান বাবু নির্বাচনী এলাকায় উপস্থিত থেকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সার্বিক তদারকি করেছেন। ঘূর্ণিঝড় মূল আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে অনেক এলাকার বাঁধ ভেঙ্গে এবং উপচে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করে স্থানীয় চেয়ারম্যান, পুলিশ, আনসার, স্বেচ্ছাসেবক ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ মেরামত করার চেষ্টা করেছি। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সঠিকভাবে এখনো নিরপন করতে না পারলেও অসংখ্য চিংড়ি ঘের, ঘর-বাড়ি ও রাস্তা-ঘাট তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থদের সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহায়তা করা হবে বলে উপজেলা প্রশাসনের এ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
বটিয়াঘাটা প্রতিনিধি পরিতোষ রায় জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাব ও চলমান পূর্ণিমার কারণে কাজিবাছা নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলবর্তী এ উপজেলার বিভিন্ন ভেঁড়িবাধ চরম হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। উপজেলার বাজার সদর রক্ষা বাঁধসহ কিসমত ফুলতলা, বরণপাড়া, হোগলবুনিয়া এলাকার ভেঁড়িবাধ রয়েছে চরম হুমকির সম্মুখীন। চলমান পূর্ণিমার কারণে নদ-নদীর পানি ফেঁপে ওঠায় ও স্রোতের তোড়ে ভেঁড়িবাধ উঁপচে পড়ে দোকানপাট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢুঁকে পড়ে ক্ষতিসাধন করছে। ওভারফ্লো হয়ে যাওয়া স্থানগুলি হচ্ছে পুরাতন ফেরীঘাট, খেওয়াঘাট, সাহা মোড়, কালীমন্দির, কিসমত ফুলতলার বরইতলা, বরণপাড়া, হোগলবুনিয়া এলাকা। ওই সকল এলাকার চরম ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়ে দাকোপ-বটিয়াঘাটা দুই উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ইতিপূর্বে নদী ভাঙ্গনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে স্ব-স্ব স্থানীয়দের অনেক জায়গা। পানি উন্নয়ন বোর্ড অসময়ে ভেঁড়িবাধ দিয়ে বয়ে যাওয়া খুলনা-চালনা মহাসড়কের কিছু কিছু জায়গায় তাঁদের মনোনীত ঠিকাদার দিয়ে নামকা ওয়াস্তা ফাইলিং এর কাজ করলেও কাজগুলি মানসম্মত ও টেঁকসই না হওয়ায় গোটা উপজেলার ওই স্পটগুলি এখন চরম হুমকীর সন্মুখীন। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় স্রোতের তোঁড়ে বর্তমানে বাঁধ সীমানা ভেঙ্গে উপজেলা সদর রক্ষাবাঁধ, উপজেলা পরিষদ ও সকল প্রশাসনিক ভবন, হেতালবুনিয়া, হাটবাটী, হোগলবুনিয়া, কিসমত ফুলতলা, বরইতলা, মাইটভাঙ্গা, ভেন্নাবুনিয়া, বসুরাবাদ, দেবিতলা, মাইল মারা, বাদামতলা, আউষখালি সহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একে তো চলমান ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর আতঙ্কে রয়েছে এলাকাবাসী তাঁরপর মরার পরে খাঁড়ার ঘাঁ অব্যাহত নদী ভাঙ্গন।
খবর পেয়ে জাতীয় সংসদের হুইপ পঞ্চানন বিশ্বাস এমপি বটিয়াঘাটা বাজার সদর, কিসমত ফুলতলার বরইতলা, বরণপাড়া এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বাসিন্দা, ব্যবসায়ী, আ’লীগ নেতৃবৃন্দদের সাথে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলি সরেজমিন পরিদর্শন করেন এবং এলাকাবাসীর আগাম ক্ষয়-ক্ষতি রোধ নিরসনকল্পে এলাকা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তাৎক্ষণিক ঔচ্ছিক সরকারী তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্ধের আশ্বাস প্রদান করেন। এছাড়াও তিনি জরুরী ভিত্তিতে শ্রমিক লাগিয়ে ও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এলাকা সুরক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান। সকল স্পটগুলিতে তাঁর সাথে উপস্থিত ছিলেন থানার ওসি মোঃ রবিউল ইসলাম, আ’লীগ নেতা অধ্যাঃ মনোরঞ্জন মন্ডল, অবঃ সহকারী শিক্ষক গৌর হরি বৈরাগী, হুইপ তনয় সহকারী শিক্ষক পল্লব বিশ্বাস রিটু, ইউপি সদস্য বিপুল কুমার ইজাদ্দার, সমাজসেবক দুলাল বৈরাগী, প্রদ্যুৎ বৈরাগী, রবি ইজাদ্দার, অংশুপতি মন্ডল, বিকাশ কুন্ডু প্রমুখ।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আব্দুল গফুর জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর ও আশশুনি উপজেলার শতাধিক গ্রাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব গ্রামের বিপুল সংখ্যক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে কয়েকশত চিংড়ি ঘের। নোনা পানির এ অঞ্চলের মানুষ পুকুরের মিষ্টি পানির ওপর নির্ভরশীল। সেসব পুকুরও নোনা পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। পানির তোড়ে শ্যামনগর উপজেলার স্বাভাবিক সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এদিকে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামবাসীর অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে না উঠলেও নিরাপদ স্থানে সরে গেছে। ফলে আশ্রয়কেন্দ্র গুলি একরকম খালি পড়ে আছে।
বুধবার সকালে শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ঝাপা গ্রামে বেড়িবাঁধের চারটি পয়েন্ট, পাতাখালির দুটি পয়েন্ট, রমজাননগরের দুটি পয়েন্ট, গাবুরার তিনটি পয়েন্ট, কৈখালির দুটি পয়েন্ট, বুড়িগোয়ালিনীর তিনটি পয়েন্ট ও নূরনগর ইউনিয়নের একটি পয়েন্ট সহ অন্ততঃ ১৬টি স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে পানি গ্রামে ঢুকে পড়েছে। এসব বেড়িবাঁধ ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ায় সয়লাব হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। এদিকে কালিগঞ্জ উপজেলার হাড়দ্দাহ গ্রামে কালিন্দী নদীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে ১০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। আশাশুনির দয়ারঘাট, কুড়িকাহনিয়া লঞ্চঘাট, হরিশখালী, সুভদ্্রাকাটি এলাকা ভেঙে নোনা পানিতে আটকে পড়েছে গ্রামবাসী। শ্যামনগর উপজেলার গাবুরার জেলেখালি, নেবুবুনিয়াম চাঁদনীমুখা, দূর্গাবটি সহ বিভিন্ন এলাকা এখন পানিতে ভাসছে। গ্রামবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা বালির বস্তা এবং মাটি ফেলে বাধ সংস্কারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউল হক দোলন বলেন, ৩০ ভাগ চিংড়ি ঘের পানির তলে তলিয়ে গেছে। এতে বিপুল টাকার মাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু জার গিফারী জানান, এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপন করা যায়নি। তবে ক্ষতির অংক হবে অনেক বড়।
এদিকে বিভিন্ন স্থানে কালভার্ট ধ্বসে নদীর পানি ছড়িয়ে পড়েছে। মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সেতু উপচে চুনা নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে এলাকা। এখন পর্যন্ত কোন প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। তবে গ্রামবাসী গবাদিপশু ও তাদের সহায় সম্পদ নিয়ে আতংকিত হয়ে পড়েছেন। সাতক্ষীরায় দিনভর বৃষ্টি হয়েছে সেইসাথে ঝড়ো হাওয়া ছিল প্রবল।

দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ জে এফ জয়

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *