April 24, 2024
আন্তর্জাতিককরোনালেটেস্ট

করোনা বিপর্যয়ের এক বছর, লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি

২০২০ সাল, রীতিমত ঘটনাবহুল একটি বছর। এ বছরের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারির খবর। সারা পৃথিবী তছনছ করে, লাখ লাখ প্রাণহানি ঘটিয়ে বিপর্যয়ের কারণ হয়েছে করোনা।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর অর্থাৎ ঠিক এক বছর আগেই চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। সেখানকার একটি সামুদ্রিক খাবার ও পশুপাখির বাজারের সঙ্গে প্রথম এই সংক্রমণের সম্পর্ক আছে বলে জানা যায়।

যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, পোল্যান্ড, ইরান, ইউক্রেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, পেরু, নেদারল্যান্ডস, ইন্দোনেশিয়া, বেলজিয়াম, রোমানিয়া, চিলি, ইরাক, কানাডা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, মরক্কো, ইসরায়েল, পর্তুগাল, সৌদি আরব, অস্ট্রিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, জর্ডান, নেপাল, পানামা, জর্জিয়া, জাপান, আজারবাইজান, ইকুয়েডর, ক্রোয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বুলগেরিয়া, বেলারুশ, লেবানন, স্লোভাকিয়া, ডেনমার্ক, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান, কুয়েত, কাতার, গ্রিস, তিউনিসিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর, ওমান, ইথিওপিয়া, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, বাহরাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, আফগানিস্তানসহ ২১৮টি দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৮ কোটি ৩০ লাখ ৬০ হাজার ৫৫৬। এর মধ্যে মারা গেছে ১৮ লাখ ১২ হাজার ৫০ জন। ইতোমধ্যেই করোনা থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে ৫ কোটি ৮৮ লাখ ৬২ হাজার ৪৫ জন।

তবে এখন পর্যন্ত করোনায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এর মধ্যেই করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি ২ লাখ ১৬ হাজার ৯৯১। এর মধ্যে মারা গেছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ৭৭৮ জন। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভারত ও ব্রাজিলের আক্রান্তের সংখ্যা যোগ করলেও তার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ অনেক বেশি।

ভারতে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৩। এর মধ্যে মারা গেছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৭৭৪ জন। অপরদিকে ব্রাজিলে আক্রান্তের সংখ্যা ৭৬ লাখ ১৯ হাজার ৯৭০ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৪০।

এদিকে চলতি বছরের গোড়ার দিকে চিকিৎসা বিষয়ক ম্যাগাজিন ল্যানসেটে চীনা গবেষকদের এক জরিপে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ ভাইরাসের উপসর্গ দেশটিতে প্রথম পাওয়া যায় গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে।

নতুন এই রোগটিকে প্রথমদিকে নানা নামে ব্যাখ্যা করা হলেও ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় কোভিড-১৯ যা ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।

নতুন এই রোগটিকে প্রথমদিকে নানা নামে ডাকা হচ্ছিল। যেমন: ‘চীনা ভাইরাস’, ‘করোনাভাইরাস, ‘এনকভ ১৯’, ‘নতুন ভাইরাস, ‘রহস্যজনক ভাইরাস’ ইত্যাদি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ১১ মার্চ কোভিড-১৯ প্রার্দুভাবকে বিশ্ব মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে।

শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুস আক্রমণকারী এই ভাইরাস পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কেড়ে নিয়েছে বহু জীবন, বহু মানুষ দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক জটিলতার শিকার হয়ে এখনও এই রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউন ও বিধিনিষেধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে পৃথিবীর কয়েক কোটি মানুষ।

বলা হচ্ছে, ১৯৩০-এর দশকে যে বিশ্ব মহামন্দা পরিস্থিতি (যা গ্রেট ডিপ্রেশন নামে পরিচিত) তৈরি হয়েছিল, তারপর এই প্রথম করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার বড় রকমের ধ্স নেমেছে। অনেকের ধারণা, মহামারি হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে, কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির যে মারাত্মক ক্ষতি এর মধ্যেই হয়ে গেছে, তা কাটাতে বহু বছর লেগে যাবে।

এই রোগের উৎস কোথায়, কখন চীন প্রথম এই রোগ সম্পর্কে জেনেছিল, এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে কতটা সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, এই ভাইরাস মানুষের তৈরি নাকি গবেষণাগার থেকে দুর্ঘটনাক্রমে তা বাইরে চলে এসেছে এসব নিয়ে সারা বছর ধরেই জল্পনা চলেছে তথ্যানুসন্ধানের প্রক্রিয়াও থেমে থাকেনি। এসব প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি জানিয়েছে কোভিড-১৯ এর উৎস খুঁজে বের করতে ১০ জন বিজ্ঞানীর একটি আন্তর্জাতিক দল জানুয়ারিতে চীনের উহান শহর সফর করবেন।

তদন্তকারী দলের একজন জীববিজ্ঞানী জানিয়েছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কারও ওপর দোষ চাপানোর উদ্দেশ্যে এই তদন্ত পরিচালনা করছে না বরং ভবিষ্যত সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করাই তাদের অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, চীনের উহানে গত বছরের ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের পর এ পর্যন্ত এটি অন্তত ১৭ বার মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেকে পরিবর্তন করেছে। অতি সম্প্রতি ভাইরাসটির নতুন এবং আরও বেশি সংক্রামক আরেকটি ধরন আত্মপ্রকাশ করার পর নতুন করে দেশে দেশে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যেই এই ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়েছে।

তবে মহামারির শুরুতে এটাও সতর্ক করা হয়েছিল যে টিকা তৈরি করতে অনেক বছর সময় লেগে গেলে মহামারি নিয়ে সব দেশই ভয়াবহ বিপদে পড়ে যাবে। তবে টিকা খুব সহজেই পাওয়া যাবে সেটাও আশা করা ভুল। তাই কিছুটা সময় হাতে নিয়েই মানুষের হাতে টিকা পৌঁছে দিতে গবেষক ও বিজ্ঞানীরা প্রাণপন চেষ্টা করে গেছেন। তার সুফলও পেয়েছি আমরা।

গত নভেম্বরে মার্কিন কোম্পানি ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেক যৌথভাবে টিকা উদ্ভাবনে তাদের সাফল্য ঘোষণা করে। সে সময় জানানো হয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রমাণ হয়েছে যে, করোনা থেকে লোকজনকে রক্ষা করতে তাদের টিকা ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর। ৬টি দেশে ৪৩ হাজার ৫শ জনের শরীরে এই টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে এতে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু দেখা যায়নি বলে জানানো হয়।

ডিসেম্বরের শুরুতে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে ফাইজার-বায়োনটেকের করোনাভাইরাসের টিকার অনুমোদন দেয় ব্রিটেন এবং শুরু হয় তাদের টিকাদান কার্যক্রম। এরপর যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুরও টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে। এছাড়া আরও বেশ কিছু দেশও জানুয়ারির শুরুর দিকেই টিকা কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে বিভিন্ন দেশে।

টিকা তৈরির যেসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এক দশকের বেশি সময় লেগে যায়, সেখানে মাত্র ১০ মাসে এই টিকা আবিষ্কারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি নজিরবিহীন অর্জন। এদিকে, যুক্তরাজ্য দ্বিতীয় টিকা হিসেবে অক্সফোর্ডের টিকার অনুমোদন দিয়েছে। আগামী সপ্তাহেই এই টিকার কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।

এই টিকা ফাইজারের টিকার চেয়ে আরও সহজলভ্য, দামে কম এবং বিতরণ ও মজুদও সহজ। সে কারণে এই টিকা সরবরাহ এবং মানুষকে টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়াও সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

অপরদিকে গত আগস্টে রাশিয়া স্থানীয়ভাবে ব্যবহারের জন্য স্পুটনিক ভি নামে তাদের তৈরি টিকাকে লাইসেন্স দিয়েছে এবং এর ব্যবহারও শুরু হয়েছে। এই টিকা ৯২ শতাংশ নিরাপদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।। অল্প দিনের মধ্যেই তাদের ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করার কথা। পৃথিবীর আরও অনেক দেশেই বিভিন্ন কোম্পানি করোনার টিকা তৈরির কাজ করছে এবং তাদের ট্রায়ালও বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। সবাই আশা করছে সফল ও কার্যকর টিকাই একমাত্র এই ভয়াবহ মহামারির আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে মানুষকে আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *