April 19, 2024
আন্তর্জাতিক

আল-কায়দার নেতৃত্বের জন্য হামজাকে প্রস্তুত করছিলেন লাদেন

 

দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক

চিঠির পর চিঠিতে নানা দিকনির্দেশনা দিয়ে নিজের প্রিয় পুত্রকে দলের নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করছিলেন আল-কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেন।

মার্কিন সেনা অভিযানে নিহত হওয়ার বছরখানেক আগে থেকে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে আত্মগোপন করে ছিলেন লাদেন। বাড়ির চার দেয়ালের ভেতর একরকম বন্দি জীবন কাটাতেন তিনি। তখন পাকিস্তান থেকে হাজার মাইল দূরে ইরানে বা সৌদি আরবে থাকতেন তার ছেলে হামজা বিন লাদেন, বয়স ছিল ২৩ বছর। লাদেন চিঠিতে ছেলেকে দলের নানা নিয়ম কানুন শিখতে বলতেন, তার কী কী গুণ থাকা উচিত এবং নিরাপত্তার জন্য তার কী কী নিয়ম অনুসরণ করা উচিত, এসব নিয়ে নানা উপদেশ ও পরামর্শ দিতেন।

ছেলের কাছে অন্য একটি চিঠিতে লাদেন লিখেছেন, পাকিস্তানে তার সঙ্গে দেখা করতে আসা এক তরুণ তাকে মেঘলা দিনে সফর করতে বলেছিলেন। আকাশ মেঘলা থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন তাকে খুঁজে পাবে না।

চিঠিতে লাদেন জটিল নিরাপত্তা প্রোটকল নিয়েও কথা নানা পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন একটি চিঠিতে তিনি ছেলেকে বলেছেন, মাথার উপর থাকা নজরদারির যন্ত্রকে ফাঁকি দিতে কোনো টানেলের ভেতর গিয়ে গাড়ি পরিবর্তন করা।

পুত্র হামজার প্রতি লাদানের এই যতœ এবং তাকে গড়ে তোলার যে চেষ্টা সেটা শুধু ছেলের প্রতি একজন পিতার ভালোবাসা নয়। বরং বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী দলের প্রধানের নিজের উত্তরসূরি তৈরি করে রেখে যাওয়ার অদম্য চেষ্টাও প্রকাশ পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তত ২০১০ সাল থেকে আল-কায়দা অত্যন্ত গোপনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হামজাকে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য করে তুলছিল। ওই প্রচেষ্টা এখন ব্যর্থই বলা যাচ্ছে। অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের দাবি, ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই হামজা নিহত হয়েছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, তিন মার্কিন কর্মকর্তা এই দাবি করলেও কখন, কিভাবে, কোথায় বা কারা হামজাকে হত্যা করেছে এসব প্রশ্নে জবাব তাদের কাছে নেই। যদি হামজার সত্যিই নিহত হন তবে তা আল-কায়দার জন্য তা নিশ্চিতভাবেই চরম আঘাত হবে।

ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর আল-কায়দার তৎপরতা কমে এসেছে। সন্ত্রাসী দলটির নতুন সদস্য দলে ভেড়াতেও বেগ পেতে হচ্ছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক জঙ্গিদল ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হঠাৎ উত্থানও আল-কায়দার সদস্য সংগ্রহে বাধা এবং কিছুটা খবরের আড়ালে ঠেলে দিয়েছে।

আল-কায়দার বর্তমান নেতা আয়মান আল-জাওয়াহরি চেয়ে প্রায় ৪০ বছরের ছোট হামজার বয়স তিরিশের কোটায়। আইএস জাওয়াহরিকে পুরান ধাঁচের এবং বর্তমান যুগ সম্পর্কে অজ্ঞ নেতা বলে কটাক্ষ করে।

সেক্ষেত্রে হামজা আল-কায়দার যোগ্য নেতা হয়ে উঠতে পারতেন। প্রথমত তিনি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় নাম বহন করছেন। বিশ্বজুড়ে জিহাদিদের মনে তার বাবার জন্য যে অনুভূতি ছিল সেটা হামজাই আবার জাগিয়ে তুলতে পারতেন। যে কারণে আল-কায়দা নেতারা আশায় ছিলেন, হামজাই আবার দলকে সংগঠিত করবেন।

সাবেক এফবিআই এজেন্ট এবং দুর্নীতি দমন বিশেষজ্ঞ আলি সোউফান বলেন, “যদি সত্যিই তিনি মারা যান তবে আল-কায়দার ভবিষ্যৎ বলে আর কিছু রইলো না। কারণ, হামজাই ছিলেন তাদের ভবিষ্যৎ। তাকে দলের নেতৃত্বের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তিনি তার বাবার বার্তা ফিরিয়ে আনার দিকেই মনযোগ দেবেন।

সোউফান ‘আল-কায়দাস লিডার ইন ওয়েটিং’ নামে হামজা বিন লাদেনের জীবনী লিখেছেন। কিন্তু হামজার মৃত্যু ঘিরে যে রহস্যের জাল তা তার জীবিত থাকার রহস্যের চেয়েও গভীর। গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা মার্কিন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একটি অভিযানে হামজার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন। তারা এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য দেননি।

হামজার মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে এবারই প্রথম নয়। ২০১১ সালে অ্যাবটাবাদে মার্কিন সেনা অভিযানে যখন ওসামা বিন লাদেন নিহত হন তখন হামজাও সেখানে মারা যান বলে খবর প্রকাশ পেয়েছিল; পরে যা ভুল প্রমাণিত হয়।

দুই বছর আগে আবারও হামজা নিহত হওয়ার খবর প্রকাশ পায়। পরে তিন ইরাকি কর্মকর্তা ওই খবর ভুল বলে জানান। হামজা সর্বশেষ আফগান-পাকিস্তান সীমান্তের কোথায় লুকিয়ে আছেন বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল।

সে অনুযায়ী বুধবার তার মৃত্যুর খবর প্রকাশের পরদিন দুই দেশের গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা হামজার মৃত্যুর বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। হামজা দীর্ঘদিন ইরানে ছিলেন। ইরান কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে কিছু নিশ্চিত করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেননি।

অ্যাবটাবাদের যে বাড়িতে লাদেন লুকিয়ে ছিলেন সেখানে অভিযানের পর তল­াশি চালিয়ে মার্কিন নৌ সেনারা হামজাকে লেখা এবং হামজার কাছ থেকে আসা কিছু চিঠি উদ্ধার করে। ওই সব চিঠির তথ্যানুযায়ী ২০০৯ ও ২০১০ সালে হামজা ইরানে বসবাস করতেন।

বুধবার এ বিষয়ে এক ইরানি কর্মকর্তা বলেন, তার ধারণা হামজা রাজধানী তেহরানে একটি অভিজাত এলাকায় দুই স্ত্রী ও এক বোনকে নিয়ে বসবাস করতেন। অন্য একজন বলেন, হামজা ইরান যাতায়াত করলেও কখনো বসবাস করেননি।

ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর এক ভিডিও বার্তায় হামজা তার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সেখানে তিনি পশ্চিমা দেশগুলোতে হামলা ডাক দেন এবং মার্কিন নাগরিকদের দেশে ও দেশের বাইরে হামলার শিকার হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেন।

তারপর ২০১৫ সালের শুরুর দিকে আল-কায়দা হামজার একটি অডিও বার্তা প্রকাশ করে। সেখানে তিনি সৌদি আরবের রাজপরিবারকে ক্ষমতাচ্যুত করার এবং সিরিয়ার বিদ্রোহী দলগুলোকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে একজোট হয়ে লড়াই করার ডাক দেন।

হামজা তার বাবাকে যখন শেষবার দেখেছিলেন তাখন তিনি মাত্র ১৩ বছরের কিশোর। আফগানিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলের একটি গোপন ঘাঁটিতে হামজা এবং অন্যান্য ছেলের শেষবার বিদায় জানিয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেন।

সেটা ছিল ২০০১ সাল। সেসময় ছিনতাই করা দুইটি উড়োজাহাজ যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’ ও পেন্টাগনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। লাদেনকে ‘আমার প্রিয় পিতা’ সম্বোধন করে এক চিঠিতে হামজা লেখেন, “আপনি আমাদের বিদায় জানালে এবং আমরা চলে গেলাম। সেটা ছিল অনেকটা দেহ থেকে আমাদের কলিজা বের করে সেখানে রেখে যাওয়ার মত।” মার্কিন সেনারা অ্যাবটাবাদে হামজার লেখা ওই চিঠি খুঁজে পায়।

হামজার মা সৌদি আরবের একজন উচ্চশিক্ষিত নারী ছিলেন। যিনি ওসামা বিন লাদেনের প্রিয় স্ত্রীতে পরিণত হন এবং তাদের একমাত্র ছেলে ছিল হামজা। বিয়ের সময় হামজার মায়ের বয়স মধ্য তিরিশের কোটায় ছিল। তার বেশ কয়েকবার গর্ভপাতের পর ১৯৮৯ সালে হামজার জন্ম হয়। সোউফানের লেখা বইতে এসব তথ্য পাওয়া যায়। তিনি আরো লেখেন, সৌদি আরবের জেদ্দায় হামজা জন্মগ্রহণ করেন। পশ্চিমা দেশগুলোর তথ্য অনুযায়ী লাদেনের মোট ২৩ জন সন্তান।

শুরুতে সব সন্তানদের সমান চোখে দেখলেও হামজা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি লাদেনের বিশেষ ভালোবাসা প্রকাশ পায়। হামজার মাও স্বামীর জিহাদের কাছে সাহায্য করা শুরু করেন। হামজার দুই বছর বয়সের সময় লাদেন পরিবার নিয়ে আফগানিস্তান থেকে সুদান চলে যান। সাত বছর বয়স পর্যন্ত হামজা সেখানে ছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপে সুদান সরকার লাদেন ও তার পরিবারকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে।

পরিবার ও অনুসারীদের নিয়ে আফগানিস্তানে ফিরে তালেবানের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন লাদেন। তারা এমন বাড়িতে বসবাস করতেন যেটিতে পানি ও বিদ্যুৎ ছিল না। এমনকি দরজা পর্যন্ত না।

টুইন টাওয়ারে হামলার পর পালিয়ে যান লাদেন। পরে তিনি ইরানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন এবং শুরুতে একটি গোপন নিরাপদ বাড়িতে বসবাস করতে বলে জানান সোউফান। ইরানে লাদেন ও তার মাকে বন্দি করে একটি সেনা ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। বড় হওয়ার পর ওসামা বিন লাদেনের ছেলে হিসেবে দলে বাড়তি কোনো সুবিধা চাননি হামজা।

২০১০ সালে লাদেনকে তার এক অনুসারি চিঠিতে লেখেন, বিশেষ একজনের ছেলে হিসেবে তিনি বাড়তি কোনো সুবিধা চাননি। আমি তাকে নিরাত্তার জন্য কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যেমন: আগ্নেয়াস্ত্র এবং আরো কিছু অস্ত্র চালানো শিখিয়ে দেওয়া।

আল-কায়দার জ্যেষ্ঠ নেতার আব্দুল­াহ আহমেদ আব্দুল­াহর মেয়েকে বিয়ে করেন হামজা। তাদের বিয়ের একটি ভিডিও অ্যাবটাবাদের বাড়িতে পাওয়া গেছে। আল-কায়দা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা টমাস জোসেলিন বলেন, আল-কায়দার হামজার ভূমিকা কী ছিল সেটা নিয়ে আমাদের স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে জানি আল-কায়দা তাকে তরুণ কণ্ঠ হিসেবে প্রচার করতে চেয়েছে। হামজার অডিও বার্তাগুলোতে সেই চেষ্টা স্পষ্ট।

হামজাকে বেশ কিছু অভিজাত প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও লাদান তার ছেলেকে জঙ্গিবাদে সরাসরি যুক্ত করতে চাননি বলেই মনে করেন জোসেলিন। লাদেনের ব্যক্তিগত তথ্য ঘেঁটে তার এটাই মনে হয়েছে। তবে হামজার নিজেদের কিছু লক্ষ্য ছিল। তার অডিও বার্তা ও বাবাকে লেখা চিঠি থেকে বোঝা যায় তিনি আল-কায়দায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাইতেন।

হামজা ২০০৯ সালে লেখা একটি চিঠিতে বলেন, আমার প্রিয় বাবা, আপনার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় আমি ছোট শিশু ছিলাম, আমার তখন ১৩ও হয়নি। কিন্তু এখন আমি বড় হয়েছি এবং একজন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ হয়েছি। কিন্তু সত্যি আমাকে কি ব্যথিত করে জানেন? মুজাহিদরা ধর্মের পতাকা তলে মিছিল করছে, কিন্তু আমি তাতে যোগ দিতে পারছি না।

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র হামজাকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ওই বছরই আল-কায়দা একটি চিঠি প্রকাশ করে। যেখানে হামজা বলেন, মার্কিন গোয়েন্দারা তার ১২ বছরের ছেলেকে হত্যা করেছে। তবে কোথায় এবং কেন হত্যা করা হয় সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।

এ বছর ফেব্র“য়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট মন্ত্রণালয় হামজার সম্পর্কে তথ্য দিতে ১০ লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে এবং সৌদি আরব তার নাগরিকত্ব বাতিল করে। যদিও মার্কিন কর্মকর্তাদের দাবি, তার আগেই তারা হামজাকে হত্যা করেছে।

 

 

 

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *