৯ বছর পর হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশ
টানটান উত্তেজনা। টেস্ট ম্যাচে এমন রোমাঞ্চের দেখা মেলে কালেভদ্রে। বাংলাদেশ কি পারবে, কঠিন পরিস্থিতি থেকে ম্যাচ জিতে মাঠ ছাড়তে? নাকি ওয়েস্ট ইন্ডিজই হাসবে শেষ হাসি? আসলে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছিল না।
লক্ষ্য ২৩১ রানের। ১৮৮ রানে টাইগারদের নবম উইকেট তুলে নেয়ার পর জয়ের পাল্লা অনেকটাই ঝুঁকে পড়ে ক্যারিবীয়দের দিকে। তবে দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে খেলাটা জমিয়ে তুললেন মেহেদি হাসান মিরাজ, শেষ উইকেটে তার সঙ্গী হলেন আবু জায়েদ।
যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ উইকেটে জয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে একটা সময় থামতেই হলো মিরাজকে, তিনি আউট হলেন। তীরে এসে তরী ডুবল টাইগারদের। মিরপুরে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট মাত্র ১৭ রানে হেরেছে বাংলাদেশ।
এতে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হলো মুমিনুল হকের দল। ঘরের মাঠে প্রায় ৯ বছর পর হোয়াইটওয়াশ হলো টাইগাররা। সবশেষ ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই এমন লজ্জায় পড়েছিল তারা।
প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ। আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি, চলতি টেস্টের প্রথম ইনিংসে ফিফটি করার আত্মবিশ্বাসটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু খুব কাছে গিয়েও সফল হতে পারেননি।
জয়ের জন্য যখন বাকি ১৮ রান, তখন শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছেন ৩১ রান করা মিরাজ, ২৩১ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে বাংলাদেশও অলআউট হয়ে যায় ২১৩ রানে।
দিনের নির্ধারিত ওভার শেষ হয়ে গেলেও, ৯ উইকেট পড়ে যাওয়ায় দুই দলের সম্মতি নিয়ে বাড়তি সময় যোগ করেন দুই আম্পায়ার। শেষ উইকেটে জয়ের জন্য ৪৩ রান প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের। কর্নওয়ালের পরপর দুই ওভারে একটি করে চার-ছয়ের মারে ২০ রান নিয়ে নেন মিরাজ, জয়ের লক্ষ্যমাত্রা নামিয়ে আনেন ১৮ রানে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারেননি। ওয়ারিকানের করা ইনিংসের ৬২তম ওভারের তৃতীয় বলটি তার ব্যাটের বাইরের কানা ছুঁয়ে চলে যায় প্রথম স্লিপে। খানিক ঝুঁকে বলটি তালুবন্দী করেন রাহকিম কর্নওয়াল। সমাপ্তি ঘটে মিরাজের ৫৬ বলে ৩১ রানের ইনিংসের, বাংলাদেশও পায় হারের স্বাদ।
অথচ অতীত পরিসংখ্যান বদলে দেয়ার মিশনে দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকারের ব্যাটে শুরুটা দুর্দান্ত করেছিল বাংলাদেশ। প্রায় দুই বছর পর গড়েছিলেন উদ্বোধনী উইকেটে ৫০ রানের জুটি। তামিম তুলে নেন নিজের ব্যক্তিগত ফিফটি। কিন্তু এরপরই ছন্দপতন। বল হাতে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে আবির্ভূত হন ক্যারিবীয় অধিনায়ক ক্রেইগ ব্রাথওয়েট।
নিয়মিত বোলাররা যখন বেধড়ক পিটুনি খাচ্ছিলেন, তখন বল হাতে নিয়েই জাদু দেখান অধিনায়ক ক্রেইগ ব্রাথওয়েট। তার বোলিংয়েই আউট হয়েছেন বাংলাদেশ দলের দুই ওপেনার সৌম্য সরকার ও তামিম ইকবাল। দুর্দান্ত শুরুর পর এ দুই উইকেট হারিয়ে যখন বিপদে বাংলাদেশ, তখন চাপ আরও বাড়ে নাজমুল হোসেন শান্তর বিদায়ের ফলে।
অথচ রান তাড়ার মিশনে শুরুটা দুর্দান্ত ছিল বাংলাদেশের। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলে চার মেরে ড্রেসিংরুমে ইতিবাচক বার্তা দেন তামিম। ডানহাতি পেসার আলঝারি জোসেফের বিপক্ষে স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে থাকেন তিনি। চতুর্থ ওভারের প্রথম বলে দৃষ্টিনন্দন কভার ড্রাইভের পর দ্বিতীয় বলে দারুণ ফ্লিকে জোড়া বাউন্ডারি হাঁকান তামিম।
অগ্রজ সতীর্থকে এমন মারমুখী ভঙ্গিতে দেখে অপরপ্রান্ত আগলে রাখেন সৌম্য। অফস্পিনার রাহকিম কর্নওয়াল তাকে বারবার প্রলুব্ধ করেন বড় শটের জন্য। কিন্তু সেই ফাঁদে পা দেননি বাঁহাতি এ ড্যাশিং ওপেনার। তবে অফস্ট্যাম্পের ওপর বল পেয়ে ঠিকই এক্সট্রা কভার দিয়ে চার মেরে দেন তিনি।
পরে বাঁহাতি স্পিনার জোমেল ওয়ারিকান আক্রমণে এলে প্যাডেল সুইপে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে জুটির পঞ্চাশ পূরণ করেন তামিম। যা কি না ১৪ ইনিংস পর উদ্বোধনী উইকেটে বাংলাদেশের পঞ্চাশ রানের জুটির নজির। ঠিক পরের বলে রিভার্স সুইপে চার মেরে ৪০ রানে পৌঁছে যান তামিম। তিনি ফিফটি করতে সময় নেননি একদমই। মুখোমুখি ৪৪তম বলে ক্যারিয়ারের ২৮তম পঞ্চাশ করেন তামিম।
তবে এর আগেই ভাঙে উদ্বোধনী জুটি। আক্রমণে এসে নিজের প্রথম বলেই সৌম্যর বিদায়ঘণ্টা বাজান ক্যারিবীয় অধিনায়ক। ব্রাথওয়েটের করা ১৩তম ওভারের প্রথম বলটিতে স্লিপে ক্যাচ নেন কর্নওয়াল। কিন্তু সেটি আউট দেননি আম্পায়ার রিচার্ড ইলিংওর্থ। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের রিভিউ নিয়ে ৩৪ বলে ১৩ রান করা সৌম্যকে ফেরায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ৫৯ রানে প্রথম উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
ব্রাথওয়েটের ব্যক্তিগত তৃতীয় ওভারে ফাঁদে পা দেন তামিম। তাকে অফস্ট্যাম্পের বাইরে ড্রাইভিং লেন্থে করেন ব্রাথওয়েট। শর্ট মিড অফে ফিল্ডার দেখেও ড্রাইভ খেলেন তামিম। কিন্তু সেই ফিল্ডারকে পরাস্ত করতে পারেননি। আউট হয়েছেন পঞ্চাশ করার ঠিক পরপরই। দুই ওপেনারকে হারিয়ে সৃষ্ট চাপ আরও বাড়ে চা পানের বিরতির ঠিক আগে কর্নওয়ালের বলে নাজমুল শান্তও (৩১ বলে ১১) ফিরে গেলে।
৩ উইকেটে ৭৮ রান নিয়ে শেষ সেশনে খেলতে নামেন মুমিনুল হক ও মুশফিকুর রহীম। তাদের ব্যাটেই ছিল বড় আশা। কিন্তু দলীয় সংগ্রহ শতক পার করে দিয়েই আগের তিনজনের পথ ধরেন অভিজ্ঞ মুশফিক। ওয়ারিকানের শার্প টার্নিং ডেলিভারিতে কট বিহাইন্ড হওয়ার আগে মুশফিকের ব্যাট থেকে আসে ৩০ বলে ১৪ রান।
ছয় নম্বরে নেমে মোহাম্মদ মিঠুন দিচ্ছিলেন ইতিবাচক ব্যাটিংয়ের ইঙ্গিত। কর্নওয়ালের বলে উইকেট ছেড়ে এগিয়ে এসে মিডউইকেট দিয়ে হাঁকান ছক্কা। অবশ্য ধরা পড়েন সেই কর্নওয়ালের বলেই। বাড়তি বাউন্সিং ডেলিভারিটি মিঠুনের ব্যাটের কানায় লেগে চলে যায় লেগস্লিপে দাঁড়ানো এনক্রুমাহ বোনারের হাতে। জয়ের লক্ষ্য থেকে ১১৬ রান দূরে থাকে অর্ধেক উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ।
মিঠুন ফিরে যাওয়ার পর লিটন দাসকে নিয়ে ষষ্ঠ উইকেটে আশা জাগিয়েছিলেন মুমিনুল। ক্যারিবীয় স্পিনারদের সামলে ভালোভাবেই এগুচ্ছিলেন তারা। কিন্তু এবার আঘাত হানেন ওয়ারিকান। তার ফুল লেন্থের ডেলিভারি পেছনে পায়ে ডিফেন্ড করতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়ানো কর্নওয়ালের হাতে তুলে দেন মুমিনুল। তার ব্যাট থেকে আসে ৬৮ বলে ২৬ রান।
দলীয় সংগ্রহ দেড়শ হওয়ার আগেই ছয় উইকেট হারানোর পরই মূলত ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ক্যারিবীয়দের হাতে। তবু স্বাগতিকদের আশা ছিল লিটন দাস ও মেহেদি হাসান মিরাজের জুটি। যারা প্রথম ইনিংসে সপ্তম উইকেটে যোগ করেছিল ১২৬ রান। কিন্তু এ ইনিংসে আর তা হয়নি। জুটির সংগ্রহ মাত্র ৬ রান হতেই কর্নওয়ালের বলে কট বিহাইন্ড হন ২২ রান করা লিটন।
পরের জুটিতে তাইজুল ইসলাম ও মেহেদি মিরাজ খেলেন প্রায় ৬ ওভার। এ জুটিও ভাঙেন কর্নওয়াল। তার বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েন তাইজুল। রিভিউ নিয়েও নিজের উইকেট বাঁচাতে পারেননি ২৫ বলে ৮ রান করা তাইজুল। দিনের তখনও বাকি ৫.৫ ওভার, দলের রান ৮ উইকেটে ১৬৩। নবম উইকেট জুটিতে নাঈম-মিরাজ খেলেন ৫.৩ ওভার।
বল হাতে নিয়ে ফের আঘাত হানেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক ব্রাথওয়েট। উইকেট না পড়লে সেটিই হতে পারত দিনের শেষ ওভার। প্রথম দুই বলে দুইটি বাই চার পায় বাংলাদেশ। তৃতীয় বলে সিঙ্গেল নিয়ে নাঈমকে স্ট্রাইক দেন মিরাজ। আগের তিনটি বল লেগস্ট্যাম্পের বাইরে পিচ করায় চতুর্থ বলটি ব্যাট উঠিয়ে প্যাডআপ করেন নাঈম।
ক্যারিবীয়দের জোরালো আবেদনে আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার। রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি নাঈম, নবম উইকেট হারায় বাংলাদেশ। পরে প্রাণপন চেষ্টা করেও দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যেতে পারেননি মিরাজ। থামতে হয়েছে জয় থেকে ১৭ রান দূরে থাকতেই।