৩৭ হাজার বোতল মদের গন্তব্য ছিল বার-ক্লাব, এনেছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান আজিজ
গার্মেন্ট পণ্যের আড়ালে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ৩৭ হাজার বোতল বিদেশি মদের চালান নিয়ে এসেছে একটি চক্র। প্রায় ৩৭ কোটি টাকার এসব মদ দুবাই থেকে আনা হয়। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার একটি ওয়্যারহাউজ হয়ে এসব অবৈধ মদের গন্তব্য ছিল ঢাকার অভিজাত হোটেল, ক্লাব ও বার। কিন্তু র্যাবের একটি বিশেষ অভিযানে বিদেশি মদের পুরো চালানটি জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে পিতা-পুত্র চক্রের তিন সদস্যকে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- আব্দুল আহাদ (২২), নাজমুল মোল্লা (২৩) ও সাইফুল ইসলাম (৩৪)।
আহাদকে ঢাকার বিমানবন্দর ও নাজমুল এবং সাইফুলকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকার ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিদেশি মদ ছাড়াও জব্দ করা হয়েছে ৯৮ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ বাংলাদেশি টাকা, ১৫ হাজার ৯৩৫ নেপালী রুপি, ২০ হাজার ১৪৫ ভারতীয় রুপি, ১১ হাজার ৪৪৩ চিনা ইওয়ান, ৪ হাজার ২৫৫ ইউরো, ৭ হাজার ৪৪০ থাই বার্থ ও সিঙ্গাপুর ডলার এবং মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত। গতকাল কাওরান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অবৈধ ওই মদের চালান এনেছিলেন আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য আজিজুল ইসলাম। তিনি মুন্সীগঞ্জের একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হন।
ব্রিফিংয়ে খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গত শনিবার র্যাব-১১ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে চট্টগ্রাম থেকে একটি ট্রাক অবৈধ পণ্য নিয়ে ঢাকার দিকে আসছে। পরে র্যাব ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁও এলাকায় একটি চেকপোস্ট বসিয়ে বিভিন্ন যানবাহন তল্লাশি শুরু করে। তল্লাশি করার সময় দুটি কন্টেইনারের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় র্যাব কর্মকর্তারা গাড়ি থামান। এ সময় দুজন ব্যক্তি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন র্যাব নাজমুল ও সাইফুল নামের দু’জনকে আটক করে। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা জানায় কন্টেইনারে অবৈধ বিদেশি সিগারেট ছিল। বিশ্বাসযোগ্য না হওয়াতে তাদেরকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা জানায় গাড়িতে অবৈধ মদ আছে এবং সেটি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা হয়েছে। তখন নারায়ণগঞ্জ কাস্টমস হাউজে এই তথ্যটি জানিয়ে তাদের একজন কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়। পরে নারায়ণগঞ্জ কাস্টমস থেকে একজন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে এসে সিলগালা করা কন্টেইনার খুলে মদের বোতল দেখতে পান। পরে তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানান। কিছুক্ষণ পরে আরও কয়েকজন কর্মকর্তা সেখানে আসার পর অবৈধ মদের বোতল গণনা শুরু হয়। পরে জানা যায়, কন্টেইনারে ৩৭ হাজার বোতল মদ রয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৩৭ কোটি টাকা।
মঈন বলেন, যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয় তাদের কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন নম্বর পেয়ে র্যাব কর্মকর্তারা ওই নম্বরে ফোন দেন। ফোন রিসিভ করে ওই ব্যক্তি বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে মদের চালানটি ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। কিছুক্ষণ পরে তাকে আবার কল করা হলে তার মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। সাইফুল ও নাজমুলের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি এই চালানটি আজিুজল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির কাছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলগড় ইউনিয়নের যাওয়ার কথা ছিল। আজিজুলের পক্ষ থেকে তার ছেলে আব্দুল আহাদ ও আশিক মুন্সীগঞ্জের ওয়ারহাউজে চালানটি রিসিভ করবে। তাদের এই তথ্যমতে র্যাব সদস্যরা ওয়ারহাউজে যায়। কিন্তু সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। সেখান থেকে জানতে পারি ঢাকার ওয়ারীতে তাদের একটি ১২ তলা বাড়ি আছে। ওই বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে তল্লাশি চালিয়ে কোটি টাকার ওপরে দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাওয়া যায়। রাতভর পিতা-পুত্রসহ তিনজনকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হয়। পরে গতকাল ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আহাদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কমান্ডার মঈন বলেন, আহাদকে গ্রেপ্তার করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা জানতে পারি তার বড় ভাই আশিক ও তার বাবা আজিজুল ইসলাম গত শনিবার ভোরে দুবাই চলে গেছে। আহাদও দুবাই যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিমানবন্দর গিয়েছিল। আহাদের কাছে আমরা তথ্য পেয়েছি এই মাদক চোরাচালানের মূলহোতা তার বাবা আজিজুল ইসলাম। পিতা ও দু’পুত্র মিলেই অবৈধ এই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। আর তাদেরকে সহযোগিতা করেন দুবাইয়ে একটি হোটেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নাসির উদ্দিন। তার বাড়িও মুন্সীগঞ্জ। নাসিরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন আজিজুল ইসলাম। নাসিরের মাধ্যমেই মদের চালান দেশে আসে।
তিনি বলেন, জাফর, শামীম নামের কয়েকজন সিএন্ডএফ এজেন্টদের আমরা শনাক্ত করেছি। তারা অসৎ উপায়ে কাস্টমস থেকে এই চালানটি বের করে দিয়েছে। চক্রটি অত্যন্ত অভিনব উপায়ে গার্মেন্ট পণ্য ঘোষণা করে মদের চালান পার করে দিয়েছে। তারা ঈশ্বরদী ও কুমিল্লার দুটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি চালান দিয়েছিল। পিতা- পুত্র তিনজনই দেশে টিভি ও গাড়ির পার্টসের ব্যবসা করে। বংশালসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের দোকান রয়েছে। এসবের আড়ালে তারা মাদক চোরাচালান করে আসছিল। তবে তারা যেসব গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের আড়ালে এসব করছে সেগুলো ভুয়া। এর আগেও তারা একই কৌশলে তিনটি চালান জানুয়ারি, মার্চ ও মে মাসে নিয়ে এসেছে। ওই চালানগুলোতে ১৪ হাজার করে মদের বোতল ছিল। এসব মদ তারা ঢাকার বিভিন্ন বড় হোটেল, বার ও বিভিন্ন ক্লাবে বিক্রি করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার আল মঈন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এই চালান শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পার হয়েছে। কীভাবে কাস্টমসের চোখ ফাঁকি দিয়েছে? কর্তৃপক্ষের সঙ্গে র্যাব এই বিষয়ে কথা বলেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, চালান ধরার পরেই আমরা কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দারের বিষয়টি জানিয়েছি। তারা বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল রয়েছেন। তারা বলেছেন স্ক্যানিং ফাঁকি দিয়েই চক্রটি এই চালান পার করেছে। কীভাবে তারা স্ক্যানিং ফাঁকি দিয়ে পার করেছে এটির তদন্ত করবে কাস্টমস।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূলহোতা আজিজুল এখন পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ বার, আহাদ ৪ থেকে ৫ বার ও আশিক কয়েকবার দুবাই গিয়েছে। চালানটি দুবাই থেকে এসেছে। বর্তমানে আজিজুল ও আশিক দুবাই অবস্থান করছে। গ্রেপ্তারকৃত আহাদ একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা হয়েছে। এখানে মানিলন্ডারিংও মামলা হয়েছে। সিআইডি তদন্ত করবে। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত আহাদ বেশকিছু বড় ক্লাব, বার ও হোটেলের নাম বলেছে। যদি এসব প্রতিষ্ঠান অবৈধ এসব মদ নিয়ে থাকে তবে সরকার বড় ধরনের রাজস্ব হারিয়েছে। তদন্ত করে দেখা হবে।