May 7, 2024
আন্তর্জাতিক

হাতে মাইক, মনে জেদ, হাথরসের দুই আসল বীরাঙ্গনা

দলিত নারীকে ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল ভারতের উত্তরপ্রদেশের হাথরস। সেখানে এক দলিত তরুণীকে ধর্ষণ এবং তার মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে যোগী আদিত্যনাথ প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।

এই ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা বরং পুলিশ আর প্রশাসনের ভয়-আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নির্যাতিতার পরিবার। হাথরসে এখন কি ঘটছে তা জানতে সাংবাদিকরা সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করলেও তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে।

পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রেখেছে পুলিশ। এই ঘটনার সূত্রধর ধরে সেখানে গিয়েছিলেন দুই নারী সাংবাদিক। এই দু’জন হলেন তনুশ্রী পান্ডে এবং প্রতিমা মিশ্র। তনুশ্রীর মতে, তিনি সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ, নিরপেক্ষতার প্রতি নন। আর প্রতিমা মনে করেন, জীবনের আসল বিষাদময়তা হচ্ছে বেঁচে থাকতে থাকতে নিজেদের ভেতরের বোধগুলোকে মেরে ফেলা। অনেকেই বলছেন, এই দু’জন হচ্ছে হাথরসের দুই আসল বীরাঙ্গনা। দেশের আকাশে নতুন দুই তারকা।

হাথরসে ধর্ষণের পর ওই নারী প্রায় ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছেন। অবশেষে নির্যাতনের কষ্ট, প্রশাসনের অবহেলা, বঞ্চনা থেকে ওপারে পাড়ি দিয়েছেন। মারা যাওয়ার আগে তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করেছেন ওই নারী।

এদিকে, ওই নারীর মৃত্যুর পর গভীর রাতে তার মরদেহ কাঠের অগোছাল চিতায় চড়িয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে যোগীর পুলিশ। ‘ইন্ডিয়া টুডে’র সাংবাদিক তনুশ্রী এবং তার ক্যামেরাপার্সন ওয়াকার আহমেদ সেই দৃশ্য দেখিয়েছিলেন পুরো দেশকে। দেখাতে দেখাতেই তনুশ্রী টুইট করেছিলেন, ‘অবিশ্বাস্য! আমার ঠিক পেছনেই হাথরস মামলার মৃতার মরদেহ পুড়ছে। পুলিশ তার পরিবারকে ঘরে আটক করে রেখেছে। আর সবার অগোচরে লাশ পোড়াচ্ছে।’

এর আগে তনুশ্রী প্রায় দেড় মিনিটের আরও একটি ভিডিও টুইট করে লিখেছিলেন, ‘নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ইউপি পুলিশ নির্যাতিতার পরিবারকে বলছে, সময়ের সঙ্গে রীতি-রেওয়াজ বদলে যায়। আপনারা মেনে নিন, ভুল করেছেন। আর পরিবারটি বলছে, আপনারা কেন আমাদের মেয়েটাকে কিছুক্ষণের জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে দিচ্ছেন না? কেন আমাদের উপর জোর খাটাচ্ছেন?’

এখন পর্যন্ত ওই ভিডিও দেখেছেন ৩৩ লাখ মানুষ। তারা দেখেছেন, হাথরসের নির্যাতিতার দেহ ‘দাহ’ করা হল না। হেলাফেলায় কাঠকুটোর মতো পুড়িয়ে দেওয়া হলো। এদিকে গত বৃহস্পতিবার থেকে হাথরসের প্রত্যন্ত ওই গ্রামে যেন নেমে এলো এক প্রতিমা।

তার নামটাও প্রতিমা মিশ্র। সারা দেশ গভীর বিস্ময় নিয়ে দেখল, গান্ধী পরিবারের নবীন প্রজন্মের দুই রাজনীতিক রাহুল-প্রিয়ঙ্কা যেখানে ঢুকতে না পেরে ফিরে এসেছেন, সেখানে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন ছোট্খাট, একহারা গড়নের এক তরুণী। ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়ছেন। পুলিশের মুখে হুট করেই মাইক ধরে বসছে আর ক্রমাগত প্রশ্ন করেই চলেছেন। করছেন তো করছেন, করেই যাচ্ছেন। তোতাপাখির মতো পুলিশ যখন বলছে, তাকে নির্যাতিতার গ্রামে ঢুকতে দেবে না, এবিপি নিউজের সাংবাদিক তখন গলা চড়িয়ে বলছেন, ‘অর্ডার কোথায়? গ্রামে ঢুকতে না দেওয়ার অর্ডার কোথায়? অর্ডার! অর্ডার! অর্ডার! অর্ডার! অর্ডার! অর্ডার! অর্ডার!’

দিশেহারা এবং ভ্যাবাচ্যাকা পুলিশ কর্মকর্তা ক্যামেরার তার ধরে টান মারছেন। তারপর মহিলা পুলিশকে ডাকছেন। তারা এসে পুঁচকে চেহারার প্রতিমাকে চালের বস্তার মতো তুলে দিচ্ছেন পুলিশের গাড়িতে। গ্রামের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে পাকা রাস্তায় তোলার পরেও তিনি মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিচ্ছেন সামনের সিটে বসে থাকা মহিলা অফিসারের দিকে। বলছেন, ‘খুব পরিশ্রম হল। না? দেখুন, দেখুন। রুমাল বার করে ঘাম মুছছেন উনি এখন!’ তারপর সহযোগী ক্যামেরাপার্সন মনোজকে বললেন, ‘ক্যামেরা বন্ধ করবে না একদম!’ বলেই আবার অন্তহীন প্রশ্ন তার। যার কোনও জবাব আসছে না। কিন্তু তিনি থামছেন না।

টানা আধঘণ্টার সেই টানাপড়েনের দৃশ্য এখনও পর্যন্ত দেখেছেন প্রায় ৫৪ লাখ মানুষ। যা দেখে চমৎকৃত প্রবীণ সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত। তার কথায়, ‘এগুলোই হচ্ছে সাংবাদিকতার নিশান। এই হামাগুড়ি দেওয়ার সময় দু’টি বাচ্চা মেয়ে যে সাহস আর দক্ষতা দেখাল, সেটা অভাবনীয়। ওদের দু’জনকেই স্যালুট।’ অশোক আরও বলছেন, ‘এরাই তো ইস্যুটা দিল রাজনীতিকদের। যেখানে রাহুলকে যেতে দিল না যোগীর পুলিশ, এরা সেখানে পৌঁছাল। শুধু পৌঁছাল না। খুঁড়ে বের করে আনল পুরো ঘটনা। ঢুকে পড়ার সাহস, বলায় আন্তরিকতা আর সাহসী ভঙ্গিতে ওদের এক চুলও নড়াতে পারেনি পুলিশ। উত্তরপ্রদেশ সরকার যে কিছুটা হলেও পিছু হটে সিবিআই তদন্তের সিদ্ধান্ত নিল, তাতে তো এদেরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা থেকে গেল।’

পরদিন যখন নাছোড় প্রতিমা গিয়ে পৌঁছেছেন নির্যাতিতার বাড়িতে, তখনও দিল্লি থেকে হাথরসের পথে রওনা হতে পারেননি রাহুল-প্রিয়াঙ্কা। তনুশ্রী-প্রতিমা হাথরসের পাতায় লিখেছেন নতুন ইতিহাস। ঘটনাস্থলে আগে পৌঁছাবেন রাজনীতিকরা। আর তাদের পিছু পিছু পৌঁছাবে সাংবাদিক। এই ছিল এই দেশের প্রথাগত চিত্র। কিন্তু তনুশ্রী-প্রতিমা সেই ব্যাকরণটাই বদলে দিয়েছেন। তারা সেখানে পৌঁছেছেন, যেখানে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল-প্রিয়াঙ্কার মতো আপাত-সর্বশক্তিমান রাজনীতিকরাও!

আসলে ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। শুধু কখনও কখনও তার পথের অভিমুখ বদলে যায়। ৪৩ বছর আগে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে বিহারের নালন্দা জেলার বেলচি গ্রামে দলিত গণহত্যার পরে স্বজনহারা পরিবারগুলোকে ভরসা দিতে ছুটে গিয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত ইন্দিরা গান্ধী। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা কাদাভর্তি রাস্তায় হেঁটে, হাতির পিঠে জমি পেরিয়ে পৌঁছেছিলেন ঘটনাস্থলে। তখনও সেখানে পৌঁছায়নি জাতীয় স্তরের কোনও সংবাদমাধ্যম।

তার মাস চারেক আগেই লোকসভা ভোটে ভরাডুবি হয়েছে কংগ্রেসের। দলের অন্দরেও ইন্দিরার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন তার বিরোধীরা। কিন্তু বিহারের সেই প্রত্যন্ত গ্রামে কার্যত রাজনৈতিক পুনর্জন্ম হয়েছিল ইন্দিরার। কর্নাটকের চিকমাগালুর লোকসভা উপনির্বাচনে জয় তাকে নিয়ে গিয়েছিল জনপ্রিয়তার নতুন শিখরে। জরুরি অবস্থার স্মৃতি মুছে ফেলে ফের দিল্লির ক্ষমতায় বসেছিলেন।

গত লোকসভা ভোটের আগে সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন প্রিয়াঙ্কা। কিন্তু হাথরস দেখাল, তিনি দাদীর চেয়ে এখনও অন্তত ৪৩ আলোকবর্ষ পিছিয়ে। দুই সাংবাদিকের মধ্যে যে অনমনীয়তা, যে জেদ দেখল পুরো দেশ, তার পাশে ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন পেশাদার রাজনীতিকরা।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীতে দীর্ঘসময় সাংবাদিকতা করা বেশ কয়েকজন বর্ষীয়ান সাংবাদিকের আবার ভিন্নমত। তাদের কথায়, ‘ওদের নিয়ে অযথা বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। এটা তো ওদের কাজেরই অংশ। আসলে এখন কেউ আর তাদের কাজটা করছে না। তাই এরা যখন নিজের কাজটা মন দিয়ে করছে, তখন সেটাকেও একটা বিশাল ব্যাপার মনে করা হচ্ছে। সামাজিক মিডিয়ায় ওদের বীরাঙ্গনা বলা হচ্ছে। আমি এর বিরোধী। একটা চাকরিকে কেন অযথা গৌরবাণ্বিত করতে যাব?’

কিন্তু দিল্লিতে তিন দশকেরও বেশি সময় সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জয়ন্ত ঘোষাল বলছেন, ‘এমন ঘটনা আমি এর আগে কখনও দেখিনি। সম্ভবত এখন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার ফলেই আমাদের পেশার কোথাও কোথাও এই আগ্রাসন বা এই বিদ্রোহ জন্ম নিচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের হিন্দি বলয়ে এমনিতেই সাংবাদিকতা করা কঠিন। সেখানে দু’টি নেহাতই বাচ্চা মেয়ে যে সাহস দেখিয়েছে, তেমনটা আমি অন্তত আমার ৩৫ বছরের সাংবাদিক জীবনে কখনও দেখিনি।’

তার মতে, এখন সবাই এটা দেখছে, শুনছে। নতুনের উন্মেষে জাগছে সারা দেশ। প্রথাভাঙা নতুন নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে দেশের আকাশে। তাদের অনেক পেছনে মিটমিট করছেন রাজনীতির তারকারা।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *