April 27, 2024
জানার আছে অনেক কিছুলেটেস্ট

সিলেট: বর্ষায় বাংলাদেশের প্রকৃত মুখ

বর্ষাকাল কি ঘোরাঘুরির সময়? আপনি হয়তো এককথায় ‘না’ বলে দেবেন। কিন্তু গন্তব্য যখন সিলেট, তখন আপনাকে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে। কারণ প্রকৃতির রানি সিলেটের প্রায় সব পর্যটনকেন্দ্র তার রূপের পেখম মেলে বর্ষাকালেই। বারবার বৃষ্টির বাগড়া, জলকাদায় মাখামাখি পথ—এর মধ্যে ভ্রমণ কিছুটা কষ্টকর বটে। তবু আমি আপনাকে ‘এলাহি ভরসা’ বলে বেরিয়ে পড়তে বলব। কারণ বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্রের বারো আনাই পড়েছে বর্ষণমুখর সিলেটে। বাকি চার আনা হলো কক্সবাজারের সাগর আর বান্দরবানের পাহাড়। এছাড়া বাদবাকি বাংলাদেশে দেখার তেমন কিছু নেই। শুধু কালের করাল গ্রাসে জীর্ণ কিছু রাজবাড়ি-জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ আর চাপা-পড়া ইট-সুরকির কয়েকটা স্তূপ আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

সবুজ পাহাড় চিরে নেমে আসা স্বচ্ছসলিলা স্রোতস্বিনী নদী, সাদা পাথরের বিছানা, মিঠেপানির জলাবন, আদিগন্ত হাওর আর মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তীর্ণ চা বাগানের কথা ভাবলেই আপনার চোখে ভেসে উঠবে সিলেটের ছবি। বর্ষাকাল হলো এসব দর্শনীয় স্থানগুলির ভরা যৌবনকাল। আমরা এখানে বৃহত্তর সিলেটের বাছাই করা পাঁচটি পর্যটনস্থানের ভ্রমণতথ্য তুলে ধরছি।

প্রকৃতিকন্যা জাফলং

মেঘালয় সীমান্তে খাসিয়া-জৈন্তা পর্বতমালার ঠিক নিচে গড়ে ওঠা এক টুকরো স্বর্গের নাম জাফলং। বরফগলা ঝর্ণাধারা পাহাড় থেকে এখানে নেমে এসে হয়েছে নদী। নদীর নাম পিয়াইন। । এত স্বচ্ছ এই নদীর পানি যে, গভীর তলের প্রত্যেকটি কাঁকড়া ও চিংড়ির নড়াচড়া পর্যন্ত খালি চোখে পরিষ্কার দেখা যায়। দু’দিকের উঁচু ঢেউখেলানো পাহাড়গুলি সবুজ বনে ছাওয়া। তার ওপরে নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। আকাশের নীলিমা, মেঘের শুভ্রতা আর বনানীর সবুজ রং পিয়াইন নদীর জলে গলে গলে পড়ছে।

নদীর পারে ছড়িয়ে আছে চা বাগান  আর কমলা বাগান। পানের বরজ। খাসিয়া পল্লীতে মাচার ওপরে ঘরবাড়ি। নদীর চরে সাদা পাথর আর সোনালি বালুর বিছানা। দুপুরের রোদে ঝলসে ওঠে প্রস্তররাশি, চিকচিক করে জ্বলে বালিয়াড়ি। চারদিকে নিভৃত শান্তি, সুনসান নীরবতা। এইসব চোখজুড়ানো দৃশ্যচিত্র নিয়ে পৃথিবীর আশ্চর্য সুন্দর একটি স্থান জাফলং।

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর

সাদা পাথর এলাকার ঠাঁই সিলেটের উত্তর সীমান্তে, কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে। সাদা পাথরে ছাওয়া রোদ-ঝলসানো বিস্তীর্ণ প্রান্তর ছাড়াও প্রতিদিন পাহাড়ি নদী, ঔপনিবেশিক রোপওয়ে, পাথরের খনি এবং সবুজ পাহাড়ের নয়ন জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে যান ভোলাগঞ্জে। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি হলো বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারি।

দু’দিকে সবুজ বনে ছাওয়া উঁচু পাহাড়। সেই পাহাড়ের ওপরে দিনমান ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের ভেলা। নীল আকাশ আর সবুজ পাহাড় ঘন ছায়া ফেলেছে নদীর জলে। মুহূর্তেই মন ভালো করে দেবার মতো আশ্চর্য সুন্দর একটি ছবি।

রাতারগুল জলাবন

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র মিঠেপানির জলাবন। এটি সিলেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলির অন্যতম। সিলেট শহর থেকে মাত্র ২৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বনকে বলা হয়ে থাকে ‘সিলেটের সুন্দরবন’। গোয়াইন নদীর তীরে ৩৩২৬ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এ বন সাধারণ কোনো বনজঙ্গল নয়। সারা বিশ্বে এমন জলাবন আছে ২২টি, আর এশিয়ায় মাত্র ২টি—একটি পড়েছে শ্রীলঙ্কায়, আর অন্যটি আমাদের এই রাতারগুল। সেজন্যেই সিলেট ভ্রমণকারীদের গন্তব্যতালিকার শীর্ষে থাকে রাতারগুল।

বনের ভেতরে ঢুকে আপনার মনে হবে, আপনি বিশাল এক প্রাকৃতিক শামিয়ানার নিচে ঢুকে পড়েছেন। বৃক্ষশাখার এমনই বিস্তৃত আর ঘন ছাউনি যে, মাটিতে রোদ পড়ে না। বছরের অর্ধেকটা সময় এ বন ডুবে থাকে দশ-পনের হাত পানির নিচে। কাজেই বর্ষায় আপনাকে বনে ঢুকতে হবে নৌকোয় চড়ে। ছোট ছোট ডিঙি নৌকো। চড়ে, বনের যত ভেতরে যাবেন তত সবুজ, ততই নিবিড় ছায়াচ্ছন্নতা। কেমন যেন সবুজ সবুজ অন্ধকার। ডালে ডালে বানর-কাঠবেড়ালির লাফঝাঁপ। প্রকৃতির এক নিজস্ব নিভৃত জগৎ এই রাতারগুল জলাবন। একবার রাতারগুল ঘুরে এলে বাকিজীবন একে আপনার আর ভুলতে হবে না।

টাঙ্গুয়ার হাওর

টাঙ্গুয়ার হাওর বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। প্রায় একশো বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠেপানির জলাভূমি। স্থানীয়দের কাছে হাওরটি ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল’ নামেও পরিচিত। সুন্দরবনের পরে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট (আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি) এবং বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি ও দেশীয় মাছের সর্ববৃহৎ অভয়ারণ্য।

টাঙ্গুয়ার হাওর ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণীর অভয়াশ্রম। প্রতিবছর শীতে দুনিয়ার বিভিন্ন শৈত্যপীড়িত দেশ থেকে অন্তত ২০০ প্রজাতির পাখি উড়ে এসে ঠাঁই নেয় টাঙ্গুয়ার হাওরে।

টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ভারতের মেঘালয় পর্বতমালা পরিষ্কার দেখা যায়। মেঘালয় থেকে প্রায় ৩০টি ছোট-বড় ঝর্ণা নেমে এসে মিশে গিয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। হাওরে দর্শনার্থীদের জন্যে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। এ হাওরের পানি এত স্বচ্ছ যে, পানির ভেতর দিয়ে হাওরের একেবারে তলা পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। চারদিক অথৈ পানিতে ঘেরা টাঙ্গুয়ার হাওরের গ্রামগুলি দেখতে ভাসমান দ্বীপের মতো লাগে।

মালনিছড়া চা বাগান

সিলেটের চা বাগান সম্পর্কে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত কে টমাসের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করার মতো। বিমান থেকে নেমে মালনিছড়া চা বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলেছিলেন: “পৃথিবীটা যে এত সুন্দর, আপনি মালনিছড়া চা বাগান না দেখলে সেটা বুঝতেই পারবেন না।”

মালনিছড়া টী এস্টেট হলো বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম চা বাগান। এরই হাত দেশে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক চা শিল্পের পত্তন ঘটে ১৮৫৪ সালে। মাইল মাইল জুড়ে বিস্তীর্ণ এ বাগান সিলেট শহরের একেবারে গা ঘেঁষে, বিমানবন্দর সড়কের দু’ পাশে। সে কারণে দেশী-বিদেশী পর্যটকেরা সিলেট ভ্রমণের শুরুতেই ছুটে যান মলনিছড়ায়।

শেয়ার করুন: