শিশু আসিফা ধর্ষণ-হত্যা: ৬ জনের সাজা
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কাঠুয়ায় বহুল আলোচিত আট বছরের শিশু আসিফা বানু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আট আসামির মধ্যে ছয়জনকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন আদালত। ‘তথ্যপ্রমাণ’ না থাকায় অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এক কিশোর আসামিকে। অপরজনের ‘বয়স নিয়ে বিতর্ক’ থাকায় তাকে বিচার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
গতকাল সোমবার পাঞ্জাবের পাঠানকোটের বিশেষ দ্রুত-বিচার আদালতের বিচারক তেজবীন্দর সিং তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তিনজনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে এ রায় ঘোষণা করেন। কাশ্মীরে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ধর্মীয় দ্বন্দ্বের কারণে বিচারে যেন ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য স্থানীয় আদালত থেকে মামলাটি পার্শ্ববর্তী রাজ্য পাঞ্জাবের পাঠানকোট আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন হলেন- অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, মন্দিরের রক্ষক এবং ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা সানজি রাম, তার বন্ধু পরবেশ কুমার, পুলিশ কর্মকর্তা দীপক খাজুরিয়া। তাদের কারাদণ্ডাদেশের পাশাপাশি এক লাখ রুপি করে জরিমানাও করা হয়েছে। আর পাঁচ বছর করে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন হলেন বিশেষ পুলিশ কর্মকর্তা সুরেন্দর বর্মা, সংশ্লিষ্ট থানার উপ-পরিদর্শক আনন্দ দত্ত ও হেড কনস্টেবল তীলক রাজ।
‘তথ্যপ্রমাণ না থাকায়’ অব্যাহতিপ্রাপ্ত কিশোর আসামি হলেন সানজি রামের ছেলে বিশাল জঙ্গোত্রা। আর ‘বয়স বিতর্কে’ বিচার প্রক্রিয়ায় না থাকা কিশোরকে (সানজি রামের ভাইপো) আইনে পৃথকভাবে তার বিচার হবে।
সা¤প্রদায়িক চিন্তা থেকে গত বছরের ১০ জানুয়ারি আসিফা বানুকে অপহরণ করে গণধর্ষণ ও পরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কাঠুয়ার একটি মন্দিরে দিনের পর দিন আটকে রেখে তাকে মাদক দিয়ে, অভুক্ত রেখে নির্যাতন করা হয় এবং ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করা হয়। এমনকি, মৃত্যু নিশ্চিত করতে পাথর দিয়ে মাথা থেতলে দেওয়া হয়। হত্যার আগমুহূর্তেও শিশুটিকে ধর্ষণ করতে চায় এক আসামি।
চারদিকে খোঁজাখুঁজির পর ১৭ জানুয়ারি মন্দিরের অদূরে জঙ্গলে আসিফার ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায়। পরে এ ঘটনায় মামলা হলে আলামত ধরে এর তিনদিন পর অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সানজি রামের ভাইপোকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক সানজি রামসহ অন্য আসামিদের গ্রেফতার করা হয়।
এ ঘটনায় ভারতজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। শিশু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের দাবি জানান বহু মানুষ। তবে গ্রেফতার আট জনেরই নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে কাশ্মীরে অবরোধ করে হিন্দুত্ববাদী উগ্র কিছু সংগঠন। তাদের সমর্থন জানিয়ে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির তৎকালীন দুই মন্ত্রী সমাবেশে যোগ দিলে বিক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। তদন্তকারীরা জানান, শিশুটিকে পরিকল্পিতভাবে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় যেন, মুসলিম স¤প্রদায়ের লোকেরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যান। পুলিশ সদস্যরা ‘আপস’ করে ধর্ষণ-হত্যার আলামত নষ্ট করেছেন।
আসামিরা গ্রেফতার হওয়ার পর আসিফার মা অভিযুক্ত সানজি রাম ও দীপক খাজুরিয়াকে মূল পরিকল্পনাকারী দাবি করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রার্থনা করেন। তিনি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, ‘আমার মেয়ের চেহারা এখনো দেখতে পাই। তাকে হারানোর কষ্ট কখনো ঘুচবে না। আশপাশে যখন তার বয়সী শিশুদের খেলতে দেখি, আমার হৃদয় ভেঙে যায়।’
আসিফা ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পরই ভারতে ১২ বছরের কম বয়সী শিশুকে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড রেখে নতুন আইন পাস করা হয়। যদিও শেষতক দোষী সাব্যস্ত হলেও আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়নি। বাদীপক্ষের আইনজীবী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ধর্মীয় বাধা সত্তে¡ও সারাদেশ একসঙ্গে এ মামলায় লড়েছে।
অবশ্য আসামি পক্ষের আইনজীবী বলেন, এ মামলা ‘পারিপার্শ্বিক প্রমাণের’ ভিত্তিতে হয়েছে। ঘটনাটি খুব বেশি গুরুতরও ছিল না। ‘আসামিরা তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি’ দাবি করে তাদের লঘু শাস্তির আবেদনও জানান তিনি।
এদিকে, এ রায় ঘোষণায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন ভারতের জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপারসন রেখা শর্মা। তিনি বলেছেন, তিনি অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি (ফাঁসি) প্রত্যাশা করেছিলেন। যেহেতু তা হয়নি, এজন্য রাষ্ট্রপক্ষের উচিত উচ্চ আদালতে সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে আবেদন করা।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিলিতে কলেজছাত্রী ‘নির্ভয়া’কে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর ফেলে দিয়ে হত্যার ঘটনায় ২০১৭ সালের মে মাসে ৬ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এদের মধ্যে পাঁচজনেরই মৃত্যুদণ্ড হয়। অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আইন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ তিনবছর কারাদণ্ড হয় কিশোর অপরাধীর।