লকডাউন শিথিলের পর বাড়ছে সংক্রমণ: বিবিসির বিশ্লেষণ
দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল গত ৮ মার্চ। আর সেই থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত ১০৪ দিনে শনাক্তের সংখ্যা সব মিলিয়ে এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে শনাক্তকৃত আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে ১০৯ দিনের মাথায়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও করোনা ভাইরাসে সংক্রমিতদের শনাক্ত করার হার এভাবেই ধীরগতিতে বাড়ছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা চূড়ায় (পিক) যেতে আরো ৪২ দিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে আশঙ্কা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। আবার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর পর চূড়ায় অবস্থানের স্থায়িত্ব একটা দীর্ঘ সময় ধরে হতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন।
আক্রান্তের হার যেভাবে বেড়েছে
দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর কয়েকদিন দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল এক অঙ্কের ঘরে। তখন পরীক্ষা করত শুধু সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। পরে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শনাক্তের সংখ্যাও ক্রমে বাড়তে থাকে। এখন দেশের ৬১টি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালকেও পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। প্রথম শনাক্ত হওয়ার প্রায় এক মাসের মাথায় ৯ এপ্রিল এক দিনে শতাধিক ব্যক্তি করোনাভাইরাস বহন করছে বলে শনাক্ত হয়। এরও প্রায় এক মাসের মাথায় গত ১১ মে এক দিনে শনাক্তের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। এভাবে শনাক্তের মোট সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়ায় গত ২ জুন। অর্থাৎ বাকি ৫০ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে শেষের ১৬ দিনে। সামনে দিনগুলোতে এই সংখ্যা আরো বাডতে থাকবে, আর এভাবে দেশে করোনাভাইরাস ক্রমেই সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘জুন মাসের প্রথম দিন থেকেই গ্রাফটা খুব খাড়াভাবে ওপরের দিকে উঠছে। এটা সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়তে থাকবে।’
এরই মধ্যে করোনা শনাক্তের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম ২০টি দেশের তালিকায় ঢুকে গেছে বাংলাদেশ। ইতালি বা ব্রাজিলের কয়েকটি শহরে যেভাবে সংক্রমণের বিস্ফোরণ দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশেও কোনো একটি জনপদে এমন সংক্রমণের বিস্ফোরণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন আরেকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে স্বল্প আয়ের মানুষরা খুব গাদাগাদি করে থাকে। এমন পরিবেশে আক্রান্তের সংখ্যায় বিস্ফোরণ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়—ব্রাজিলের সাও পাওলো বা রিও ডি জেনিরোতে যেমনটা দেখা গেছে।’
দেশে পিক টাইম কবে আসবে
ব্রিটেনে করোনা সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায় বা পিক টাইম ৪২ দিন ধরে স্থায়ী ছিল। বাংলাদেশে এর চেয়েও বেশি সময় ধরে এই পিক টাইম স্থায়ী হতে পারে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ।
ইউরোপের আরেক দেশ ইতালিতে পিক টাইমের স্থায়িত্ব ছিল আরো কম। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা যেমন দ্রুতগতিতে বেড়েছে, তেমনি দ্রুতগতিতে সেটা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে আবার বেশ দ্রুত নেমেও এসেছে। দেশটিতে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৩০ জানুয়ারি। মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার গ্রাফ হু হু করে ওপরের দিকেই উঠতে থাকে। মার্চের শেষের দিকে শনাক্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর ধীরে ধীরে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমে আসতে থাকে। অর্থাৎ প্রথম কোনো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়া থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে ধীরে ধীরে নেমে আসা, ইতালিতে এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে দুই মাসের মধ্যে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথম শনাক্তের পর তিন মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখানে আক্রান্তের সংখ্যা এখনো ঊর্ধ্বমুখী। আক্রান্তের হার কবে নাগাদ সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাবে, সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায় কখন আসবে এবং সেটা কত সময় ধরে স্থায়ী হবে সেটা নির্ভর করবে, কত টেস্ট করা হচ্ছে, মানুষ কতটা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে, সরকার কতটা কঠোরতা আরোপ করছে এবং নজরদারি করছে—এসবের ওপর।
লকডাউনের কড়াকড়ি, যথাযথ আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিন ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার মাধ্যমে চীন ও ইতালি দ্রুত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দমন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সেই নীতি অনুসরণ করলে সংক্রমণের মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
‘লকডাউন’ শিথিলের পর থেকেই সংক্রমণ বেড়ে চলেছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন ও ইতালির দেখাদেখি বাংলাদেশ যদি শুরু থেকেই ‘লকডাউনে’ কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন সঠিক ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসত, তাহলে এত দিনে বাংলাদেশ সংক্রমণের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে নিচে নেমে আসা শুরু করত। তবে এখনো যদি কঠোরভাবে জোনভিত্তিক ‘লকডাউন’ কার্যকর করা হয়, রোগী শনাক্ত করে তাদের যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়, অর্থাৎ কমিউনিটি থেকে যদি সংক্রমণ কমিয়ে আনা যায়, তাহলে সংক্রমণের বিস্ফোরণ রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন ড. মুশতাক হোসেন। সে ক্ষেত্রে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত পর্যায় দেখা যেতে পারে বলে তিনি জানান।
একই মত ডা. বে-নজির আহমেদেরও। তিনিও জোর দিয়েছেন জোনভিত্তিক ‘লকডাউন’ কার্যকর করার ওপরে। তিনি বলছেন, ‘সরকার জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যকরভাবে সম্পাদন না করলে, আর সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানতে দায়িত্বশীল না হলে, চূড়ান্ত পর্যায়ে আসতে আরো দেরি হবে।’
বে-নজির আহমেদ আরো বলেন, ‘সংক্রমণের ঝুঁকি হিসেবে যদি এক হাজারটি হটস্পট বা রেড জোন চিহ্নিত করে লকডাউন করা হয় এবং প্রতিটি রেড জোনে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দলের মাধ্যমে কড়াকাড়ি আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়, তাহলে ৪২ দিনের মাথায় সর্বোচ্চ সংখ্যাটি দেখা যাবে।’ না হলে সামনের দিনগুলোতে সংক্রমণের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।
অন্যদিকে মুশতাক হোসেনের আশঙ্কা হলো, করোনা সংক্রমণের কার্ভ একবার নেমে যাওয়ার পর সেটা হয়তো আবারও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। যেমনটা দেখা গিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লুর সময়টাতে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বৃহস্পতিবারের প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে জানিয়েছেন যে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দ্রুত বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে না।
গণহারে নমুনা পরীক্ষায় গুরুত্ব বিশেষজ্ঞদের
ইউরোপে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর ওই সব দেশ থেকে যে যাত্রীরা বাংলাদেশ এসে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন তাদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে বলে ধারণা করছেন বে-নজির আহমেদ।
বিদেশ থেকে আসা সেই মানুষরা সীমিত সংখ্যায় ছিল। তাদের কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি পুরোপুরি না হোক আংশিক হলেও নিশ্চিত করা গেছে। এরপর সরকার আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়, আর ২৬ মার্চ থেকে ‘সাধারণ ছুটি’ কার্যকর করা হয়। সে সময়ে করোনা ভাইরাসের কার্ভ নিচের দিকেই ছিল। কিন্তু যখন থেকে ‘লকডাউন’ শিথিল করা হয়, গার্মেন্ট, দোকানপাট, অফিস-আদালত খুলে দেওয়ার পাশাপাশি পরীক্ষার সংখ্যাও বাড়ানো হয়, তখন থেকে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী চিত্র নজরে আসে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখে বলছেন, সামনে এটা আরো বাড়বে।
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘লকডাউন চলা অবস্থায় গার্মেন্ট কারখানাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে, ঈদের সময় বিভিন্ন দোকানপাট চালু করা হয়, ঈদকে ঘিরে বিপুলসংখ্যক মানুষ যাতায়াত করেছে। লকডাউনের সেই শিথিলতার প্রভাব এখন দেখা যাচ্ছে।’
ইতালি ও চীনে দ্রুত চূড়ান্ত পর্যায় দেখতে পাওয়ার একটি বড় কারণ হলো ম্যাস টেস্টিং, অর্থাৎ গণহারে নমুনা পরীক্ষা। সে কারণে ওই দেশগুলোতে ঊর্ধ্বমুখী কার্ভ দেখা গেছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষার সংখ্যা এখনো অনেক কম। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে দৈনিক ১৫-১৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। শুরুতে এই পরীক্ষার সংখ্যা ছিল কয়েক শর মতো। বর্তমানে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোয় আক্রান্তের এই ঊর্ধ্বমুখী চিত্র নজরে আসছে বলে মনে করেন বে-নজির আহমেদ। তবে গণহারে পরীক্ষা করা হলে প্রকৃত সংখ্যা বেরিয়ে আসত এবং সেই হিসেবে সংক্রমণের চূড়া নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া সম্ভব হতো বলে তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু দেশের বাস্তবতা ও সক্ষমতার প্রশ্নে গণহারে পরীক্ষা করা কঠিন বলে মনে করছেন মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে পরীক্ষার যে সক্ষমতা তার ওপর চাপ পড়ছে, তাই যাদের লক্ষণ নেই তাদের সবার পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে। যেমন—এক্স-রের মাধ্যমে যদি কারো নিউমোনিয়া পাওয়া যায়, তাহলে তাদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করে চিকিৎসা দিতে হবে।’