যশোরের বৃষ্টির বাড়িতে কান্নার রোল
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
আগুন আর ধোঁয়া থেকে বাঁচতে ১২ তলা থেকে ১৮ তলা পর্যন্ত গিয়েছিলেন বৃষ্টি। স্বামী, বাবাসহ স্বজনদের কাছে বারবার আকুতি জানিয়েছিলেন কীভাবে বাঁচবেন এই নরককুণ্ডু থেকে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি যশোরের মেয়ে শেখ জারিন তাসমিম বৃষ্টির।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডে নিহত শেখ জারিন তাসমিম বৃষ্টির বাবার বাড়িতে এখন চলছে মাতম। কান্নার রোল পড়ে গেছে নিহতের স্বজনদের মধ্যে।
গতকাল শুক্রবার দুপুর দুইটা দশ মিনিটে লাশবাহী গাড়িতে বৃষ্টির মরদেহ পৌঁছায় যশোর শহরের বেজপাড়া মেইন রোডে নিহতের বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শেখ মোজাহিদুল ইসলামের বাড়ি ‘প্রতীক্ষা’য়।
মরদেহ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে নিহতের আত্মীয়-স্বজনসহ প্রতিবেশীদের মধ্যে কান্নার রোল ওঠে। এরপর মরদেহ গাড়ি থেকে নামিয়ে বাড়ির সামনে উঠোনে রাখা হয়। দুপুরে যশোরে বৃষ্টির মরদেহ পেঁছানোর পর পুরনো বাসস্ট্যান্ড মসজিদে প্রথম জানাজা হয়।
তার বাবা শেখ মোজাহিদুল ইসলাম জানান, বাদ আছর ফের বেজপাড়া মসজিদে নামাজে জানাজা হবে। এরপর তাকে যশোর শহরের কারবালা গোরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
বৃষ্টির বাবাসহ স্বজনরা এই মৃত্যুর জন্য বিল্ডিংয়ের মালিকসহ প্রশাসনকেই দায়ী করেছেন। তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং এ ঘটনার জন্যে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বলেন, ভবিষ্যতে যেন এমন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। বিনা কারণে যেন মানুষ মারা না যায়।
নিহতের বাবা শেখ মোজাহিদুল ইসলাম এবং শ্বশুর কাজী ইরাদ বলেছেন, অপরিকল্পিতভাবে তৈরি এই বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি মোটে তিন ফুটের। এইরকম সরু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামা সম্ভব না। তাছাড়া ইমার্জেন্সি এক্সিটগুলো বন্ধ করে দারোয়ানরা আগেই পালিয়ে যায়; সেকারণে রুমে থাকা মানুষজন আর বের হতে পারে না। তাদের দাবি, বিল্ডিংয়ের ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। কেননা ছাদে উঠার দরজাও ছিল বন্ধ।
নিহতের স্বামী যশোরের পুরাতন কসবা এলাকার কাজী সাদ নূর বলেন, ‘বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বৃষ্টির সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়। বৃষ্টি বলছিল- আগুন আর ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমি তাকে বলি, দৌঁড়ে উপরের দিকে চলে যাও। ১৮ তলায় অবস্থানকালে সে (বৃষ্টি) জানায়, ধোঁয়ার কারণে আর যেতে পারছে না। এ সময় পাশ থেকে তার সহকর্মীরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল যে, তারা পাশেই আছে।’
এরপর থেকে তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান কাজী সাদ। মোবাইলফোন সেট অনেকক্ষণ বন্ধ ছিল।
সাদ নূর বলেন, ‘আমার ছোটভাই ওই নাম্বারে লাগাতার ফোন দিতে থাকে। একপর্যায়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফোন কল রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে বলা হয়- তিনি ফায়ার সার্ভিসের লোক। সিমের মালিক মারা গেছেন।’
ফায়ার সার্ভিসের ওই ব্যক্তি নূরকে জানান, মৃতার ফোন সেট থেকে সিম বের করে তিনি ফোনকল রিসিভ করেছেন।
নিহতের বাবা শেখ মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গতকাল সকাল দশটার দিকে বৃষ্টির সঙ্গে আমার কথা হয়। সেইসময় সে অফিসে যাচ্ছিল।’
দুপুরে জামাই তাকে জানান, বৃষ্টিদের অফিসে আগুন লেগেছে। এরপর তিনি রাত নয়টায় ঢাকার উদ্দেশে যশোর ছাড়েন। ভোর তিনটার দিকে তিনি ঢাকায় পৌঁছান।
যশোর শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী বৃষ্টি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানবসম্পদ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। মানবসম্পদ বিভাগে কর্মকর্তা হিসেবে তিনি কাজ করতেন বনানীর এফ আর টাওয়ারের ইইউআর সার্ভিস বিডি লিমিটেডে।
২০১৬ সালে ২৬ মার্চ সহপাঠী যশোরের পুরাতন কসবা এলাকার কাজী সাদ নূরের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। কাজী সাদ নূর ঢাকার রেডিসন হোটেলে সহ-ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। চাকরির সুবাদে ঢাকার খিলক্ষেতে বসবাস করতেন তারা। মাত্র দুদিন আগে ২৬ মার্চ তৃতীয় বিয়ে বার্ষিকী উদযাপন করেন তারা।
বৃষ্টি তার ফেসবুকে স্বামীর সঙ্গে তোলা ছবি দিয়ে হ্যাশট্যাগে লিখেছিলেন, ‘আলহামদুলিলাহ, একসাথে ১০৯৫ দিন, শুভ বিবাহবার্ষিকী, ২৬ মার্চ মি ও নূর…।’ কিন্তু সেই আনন্দঘন মুহূর্ত একদিন পরই স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।
দুই বোনের মধ্যে বৃষ্টি ছিল ছোট। বড় বোন সানজিদা ইসলাম ববিও ঢাকায় বসবাস করেন।
বৃষ্টির চাচা রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, অত্যন্ত মেধাবী ও মিশুক ছিল বৃষ্টি। বাদ আছর তার নামাজে জানাজা শেষে যশোর শহরের কারবালা কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।