May 2, 2024
আঞ্চলিকলেটেস্ট

মশিয়ালীতে উত্তেজনা, আরও দু’জনের মৃত্যু

* গুলিবিদ্ধ আরও একজনের মৃত্যু, গণপিটুনীতে একজন নিহত
* জাফরিনের সহযোগী গ্রেফতার, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ অব্যাহত
* আইন হাতে না তুলে নেওয়ার আহ্বান পুলিশ কমিশনারের

দ. প্রতিবেদক
খুলনার খানহাজাহান আলী থানাধীন মশিয়ালীতে প্রতিপক্ষের গুলিতে আহত আরও একজন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে গুলিতে তিনজনের মৃত্যু হলো। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে অপরপক্ষ প্রতিপক্ষের একজনকে গণপিটুনিতে নিহত করেছে। এছাড়াও বসতবাড়িতে ভাংচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মশিয়ালী গ্রামে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি শান্ত করতে পুলিশি চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনায় খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক মোঃ জাকারিয়াকে দল থেকে বৃহস্পতিবার রাতে বহিস্কার করা হয়েছে।

জাকারিয়া বাহিনীর গুলিতে গুরুতর আহত সাইফুল ইসলাম (২২) খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত পৌনে ১টার দিকে মারা যায়। অপরপক্ষের গণপিটুনিতে জাকারিয়ার চাচাতো ভাই জিহাদ শেখ (৩০) নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ জনে।

স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে মুজিবর নামে এক ব্যক্তিকে অস্ত্রসহ খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া এবং তার ভাই খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি জাফরিন ও মিল্টন পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। মুজিবরের গ্রেফতার নিয়ে মূল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এরপর গ্রামের বেশ কয়েকজন জাকারিয়ার বাড়িতে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে যায়। এসময় জাকারিয়া ও তার লোকজনের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে জাকারিয়া, জাফরিন, কবির ও মিল্টন তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ সময় গুলিতে নজরুল ইসলাম, গোলাম রসুল, সাইফুল ইসলাম, শামীম, রবি, সুজন, রানা ও খলিলসহ ৮-১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধদের উদ্ধার করে ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক নজরুল ইসলাম ও গোলাম রসুলকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত অন্যান্যদের প্রাথমিক চিকিৎসার পর খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত পৌনে ১টার দিকে সাইফুল ইসলাম মারা যায়। এ ঘটনার পর রাত ২টার দিকে ক্ষুব্ধ অপরপক্ষের গণপিটুনিতে জাকারিয়ার সহযোগী জাহিদ শেখ (৩০) মারা যায়।
খুমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. সেলিম রেজা জানান, মৃত অবস্থায় জাহিদ শেখকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাখা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রমজান মাসে মশিয়ালী গ্রামের তুহিনের সাথে জাফরিনের দ্বন্দ্ব হয়। এর জের ধরে ঈদুল ফিতরের দিন জাফরিনদের সাথে গ্রামবাসী মুখোমুখি অবস্থান করে। তখন পুলিশের হস্থক্ষেপে উভয় পক্ষ পিছু হেটে যায়। ঐ ঘটনার সুত্র ধরে কয়েক দফা গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি জাফরিনদের হামলার স্বীকার হয়। এতে জাকারিয়া-জাফরিন-মিল্টন তিন ভাই ও তাদের সমর্থকদের সাথে গ্রামবাসীর শত্রুতা সৃষ্টি হয়।
এছাড়াও মশিয়ালী পূর্বপাড়া মসজিদ কমিটির নির্বাচনে মোঃ জাকারিয়া সভাপতি পদে প্রার্থী হন। শুক্রবার সেই নির্বাচনের দিনধার্য্য ছিল। এই নির্বাচনে জাকারিয়ার প্রতিপক্ষরা তাকে মেনে না নেওয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়।
এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার খানজাহান আলী থানা পুলিশ আলিম জুট মিলের শ্রমিক মুজিবর শেখ (৪৫) কে গোলাবারুদসহ আটক করে। এ খবর পেয়ে ওই জুটি মিল শ্রমিক মুজিবরের স্বজন ও গ্রামের কয়েকজন তাকে ছাড়াতে যায়। কিন্তু পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে তারা রাত ৮টায় মশিয়ালীর হাড়াতলার মোড়ে আসলে তিন সহোদর জাকারিয়া-জাফরিন-মিল্টন, তাদের চাচাতো ভাই জিহাদ, সহযোগি আলমগীর, জাহাঙ্গীর, আরিফ, আজিমসহ ১০/১২ জনের সাথে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে গোলাবারুদ ও ককটেল বোমা ব্যবহার করা হয়। এ সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই দুইজন মারা যান। রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়।
তাদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ উত্তেজিত গ্রামবাসী জাকারিয়া, জাফরিন, মিল্টনের বাড়ী, অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং জিহাদ, জাহাঙ্গীর, সাগর ও রাজুর বাড়ীসহ মোট ১১টি স্থানে ভাংচুর করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় জাকারিয়ার চাচাতো ভাই জিহাদ (৩০) গ্রামবাসীর হামলায় নিহত হন।
শুক্রবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, জাকারিয়াদের মশিয়ালীর আালিশান রাজমহলের প্রতিটি কক্ষ এবং ভবনের মধ্যে থাকা একটি প্রাইভেট গাড়ী, দুটি মটরসাইকেলসহ সকল আসবাবপত্র আগুনে পুড়ে দাউদাউ করে জ্বলছে। শত শত নারী পুরুষ সেখানে ঘিরে রেখেছেন। পুলিশ এবং সংবাদকর্মীদের তারা ঢুকতে দিচ্ছেন না। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন। এসময় এলাকাবাসী জাকারিয়ার ফাঁসির দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল করে ও বসতবাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে।
পুলিশের হস্তক্ষেপে দুপুরের পরে মশিয়ালী গ্রামের পরিস্থিতি শান্ত হয়। এলাকায় তিন প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এর আগে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আসেন ডিসি নর্থ মোল্লা মো. জাহাঙ্গীর আলম, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সোনালী সেন, দৌলতপুর জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার বায়জিদ ইবনে আকবরসহ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ। তারা গ্রামবাসীর সাথে কথা বলেন এবং ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শস্তি নিশ্চিতের আশ্বাস প্রদান করেন।
খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবিদ হোসেন বলেন, গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে জাকারিয়াকে আওয়ামী লীগ থেকে বৃহস্পতিবার রাতেই বহিস্কার করা হয়েছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) কানাই লাল সরকার জানান, মশিয়ালীতে গোলাগুলির ঘটনায় মোট চারজন নিহত হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এ ঘটনায় জাফরিনের একজন অন্যতম সহযোগী জাকিরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনও কোন মামলা হয়নি। তবে মামলার প্রস্তুতি চলছে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (উত্তর) মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন এর মাধ্যমে এলাকাবাসীর উদ্দেশ্যে পুলিশ কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির পিপিএম (সেবা) মোবাইল ফোনে স্পিকারে বার্তা প্রদান করেন। এসময় পুলিশ কমিশনার আইন হাতে না তুলে নিয়ে প্রশাসনকে সহযোগিতার আহবান জানান এবং বলেন, ঘটনার সাথে জড়িতদের আটকের চেষ্টা চলছে এবং দোষীরা আটক না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ ব্যারাকে ফিরবেনা বলেও জানান তিনি।

এদিকে বিকালে নিহত মিল শ্রমিক নজরুল ইসলাম (৫৫) ও রাজমিস্ত্রীর হেলপার গোলাম রসুল (৩৫) ও কৃষক সাইফুলের লাশ গ্রামে আনা হলে গ্রাম জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। স্বজন আর গ্রামবাসীর কান্নায় এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। নিহত তিনজনকে এক সাথে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ এম জে এফ

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *