December 23, 2024
ফিচারশিক্ষাসাক্ষাৎকার ও মতামত

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ভূমিকা

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা। যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্বের সামগ্রিক উন্নয়নে অংশীদার হতে প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণ তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনব্যবস্থায় পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছে। স্থানীয় পর্যায়ে প্রত্যেক জনপ্রতিনিধি তার নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রত্যাশা পূরনের ম্যান্ডেট নিয়েই ভোটে নির্বাচিত হয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হয় এবং তার সামগ্রিক কার্যক্রমের জন্য জনগণের নিকটই দায়বদ্ধ থাকে। তাই প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধিরা যদি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে সমন্বয় করে কাজ করে, তবে অতিসহজেই উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত হয় এবং সার্বিক অগ্রগতি সাধিত হয়।

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ওপর দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে এবং ৫৯ ও ৬০ নং অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত বিশদ আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  এরই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি আইন প্রবর্তিত এবং কার্যকর হয়েছে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে জাতীয়ভাবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ তাঁদের স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নে জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেন। আর সেসব আইন বাস্তবায়নে জেলা পর্যায়ে কাজ করেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ সদস্যগণ; উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ সদস্যগণ; ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ সদস্যগণ; সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরগণ এবং পৌরসভার মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরগণ। অর্থাৎ প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত প্রত্যেকেই জনপ্রতিনিধির আওতাভুক্ত।

একজন সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও দূরদর্শী জনপ্রতিনিধির যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকারের গৃহীত যেকোন পদক্ষেপ সফলভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে। সুষম জাতীয় উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ও গতিশীল সমাজ সৃষ্টিতে দক্ষ মানব সমাজের বিকল্প নেই। আর দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষা। রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০২১  বাস্তবায়নে শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন অতীব জরুরী। শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা ও চেতনা জাগ্রতকরণ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুশীলন ও অসা¤প্রদায়িক চিন্তার বিকাশ সাধনের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশুদের নিট ভর্তির হার ৯৭.৯৪%(প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর) হলেও ইউনিসেফের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী চতুর্থ শ্রেণীর পর থেকে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ ড্রপ আউট হার কমানোর ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর বর্তমান বিশ্বে চলমান টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ (ঝউএ) এর অভীষ্ঠ-৪ (মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ) অর্জনের লক্ষ্যে সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একক স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে তারা নিজ নিজ পরিসরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে পারেন।

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কর্মপরিধিসমূহঃ

  •         স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের স্ব স্ব ক্যাচমেন্ট এরিয়াতে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নিয়মিত পরিদর্শন করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোটিভেশন প্রদান করতে পারেন। এক্ষেত্রে তাঁরা শিক্ষকদেরকে সঠিকভাবে আন্তরিকতার সাথে পাঠদান বিষয়ে এবং শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে জোর দিতে পারেন, যাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ড্রপ আউট হার হ্রাস পায়।
  •     প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলোতে অগ্রাধিকার প্রদান এবং নিজ এলাকার জন্য বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ।
  •       প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করার লক্ষ্যে প্রতিটি প্রাথমিক স্কুলে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন স্থাপন, প্রজেক্টর ও মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ক্লাস পরিচালনা নিশ্চিতকরণ।
  •       বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার বৃদ্ধিকরণে অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ, যাতে সকল মৌসুমে শিক্ষার্থীরা কম সময়ে ও কম খরচে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে পারে।
  •        পূর্ণযোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষা বিষয়ক প্রকল্প গুলোর মাধ্যমে শিক্ষকদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং কারিগরি শিক্ষার প্রতি শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধকরণে সহায়তা প্রদান।
  •     বিদ্যালয়গুলোর টয়লেট পাকাকরণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার উপকরণ সরবরাহ, এবং কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে কার্যকরী ভূমিকা পালন। মেয়ে ও প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য পয়নিষ্কাশন অবকাঠামো ও পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করে তাদের উপস্থিতির হার বাড়াতে পারেন। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন, খুলনার উদ্যোগে  গৃহীত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে “সেলুব্রিয়াস সেন্টার ও রিফ্রেশমেন্ট কর্তার ইনক্লুডিং অটিজম স্টুডেন্টস” প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও তদাকরিতে জনপ্রতিনিধিগণ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।
  •      “রূপকল্প ২০২১” ও “রূপকল্প ২০৪১” বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার ইন্টারনেট সংযোগসহ কম্পিউটার প্রদান করছে এবং ওঈঞ ল্যাব স্থাপিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রতিনিধিরাও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ সকল ডিজিটাল উপকরণসমূহ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকি নিশ্চিত করতে পারেন।
  •     শিশুদের ঝরে পড়ার পিছনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি সামাজিক রীতিনীতির ভূমিকা রয়েছে। তাই সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে জনপ্রতিনিধিরা মোটিভেশনাল বক্তব্য দিতে পারেন।
  •       বাল্যবিবাহ ও শিশু শ্রম এর ফলে অনেক শিশুর মাঝ পথে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। সেজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ বিভিন্ন সময় সভা-সেমিনার করে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারেন এবং এগুলোর কুফল সম্পর্কে অবহিত করতে পারেন।
  •     বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় সাধন করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সভা, সেমিনার এর আয়োজনে সহায়তা প্রদান।
  •        শিক্ষার্থীদের শিল্পকলা, লাইব্রেরী, সংগীত বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য বিদ্যালয়ে এসব উপকরণ সরবরাহে ব্যবস্থাপনা ও সহায়তা করতে পারেন।
  •       স্থানভিত্তিক চিত্তাকর্ষক শিক্ষা পঞ্জিকা প্রণয়নের মাধ্যমে চর, হাওর, বিল, উপক‚ল, পার্বত্যঅঞ্চলসহ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ  এলাকা ও সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের সময়সূচি প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন।
  •       বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ইতিহাস, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নৈতিকতা ও সংস্কৃতি বজায় রাখাসহ পরিবেশ রক্ষার বিষয় সম্পর্কে শিশুদের সম্যক ধারণা প্রদান।
  •       সড়ক নিরাপত্তা, মাদক নিয়ন্ত্রণ, বৃক্ষরোপণ প্রভৃতি বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা প্রদানসহ শিক্ষার্থীদের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় উদ্বুদ্ধকরণ।

একজন দক্ষ ও যোগ্য নেতা জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে যেকোন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম। বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের মাধ্যমে সর্বস্তরের বাঙ্গালিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে। আর এর মাধ্যমেই পশ্চিম পাকিস্তানের সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে বাঙ্গালি জাতি ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। তাই একজন যোগ্য জনপ্রতিনিধিকেও ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের গুণাবলিতে গুণান্বিত হতে হবে, যেন তিনি সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে সমন্বয় করে সরকারের যেকোন গৃহীত পদক্ষেপ যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে প্রত্যেক জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহের বাস্তবায়নে প্রশাসনকে সার্বিক সহায়তা প্রদান। জেলা প্রশাসন, খুলনার উদ্যোগে ইতোমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ”চাইল্ড ইন্টেগ্রিটি ও শিশু বঙ্গবন্ধু ফোরাম” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিশুদের নৈতিকতা, মূল্যবোধ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণসহ সার্বিক উন্নয়নে তদারকিসহ স্থানীয় অভিভাবক ও শিশুদেরকে সকল কার্যক্রমে সম্পৃক্তকরণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে সহায়তার মাধ্যমে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এর মাধ্যমেই বৈশ্বিক পরিমÐলে নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্বদানে যোগ্য করে তুলতে ভূমিকা রাখতে পারেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ।

 

 

মোহাম্মাদ হেলাল হোসেন 

বিএ (অনার্স), এমএ (ঢাবি)

পিজিডি (লন্ডন), এমবিএ (লন্ডন)

ডক্টরঅববিজনেজএ্যাডমিনিস্ট্রেশন (রিসার্সার)

বিসিএস (প্রশাসন)

 

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *