পুতিন-এরদোয়ানকে বন্ধু বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রই
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে একঘরে করতে উঠে পড়ে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল করতে জোটের যে সদস্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেই তুরস্কই বাঁধ সাধছে। মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা মানতে রাজি নয় তারা। এমনকি যে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু তালিকার শীর্ষে, সেই ইরানের আতিথ্য গ্রহণ করে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে তেহরান গেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।
এটি পরিষ্কার যে, গত কয়েক বছরে পুতিনের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা জলাঞ্জলি দিতে রাজি নন এরদোয়ান। কিন্তু রাশিয়া-তুরস্কের সম্পর্কের যে ইতিহাস, যে মাত্রার স্বার্থের দ্বন্দ্ব এখনো দুই দেশের মধ্যে রয়েছে, তাতে দুই নেতার এই বন্ধুত্ব নিয়ে সন্দিহান অনেক পর্যবেক্ষকই।
রাশিয়া-তুরস্কের পুরোনো বিরোধ
সিরিয়ায় রাশিয়া ও তুরস্কের সৈন্যরা এখনও কার্যত মুখোমুখি। সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রেসিডেন্ট আসাদকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দিতে চায় না তুরস্ক। বরং দেশটির আরও এলাকা দখলের পরিকল্পনা রয়েছে আঙ্কারার।
২০১৫ সালে সিরিয়া সীমান্তে একটি রুশ যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করে তুরস্ক, যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
আজারবাইজানেও দেশ দুটো ভিন্ন দুই প্রান্তে। নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধে তুরস্কের সাহায্য নিয়ে আজারবাইজান যখন আর্মেনিয়াকে কোণঠাসা করতে শুরু করে, তখন রাশিয়া হস্তক্ষেপ করে যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দেয়।
লিবিয়ায় অস্ত্র, টাকা-পয়সা দিয়ে পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণকারী মিলিশিয়া নেতা খালিফা হাফতারকে সাহায্য করছে রাশিয়া। অথচ তুরস্ক সমর্থন করছে ত্রিপলির সরকারকে।
পুতিন ও এরদোয়ানের ‘বেমানান’ সম্পর্ক
এত কিছুর পরেও পুতিন ও এরদোয়ানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ এই সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হলো এবং তা কীভাবে টিকে রয়েছে, এই প্রশ্ন উঠছে। লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণাধর্মী সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান সম্পাদক ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক সামি হামদী বলেন, এই বেমানান’ সম্পর্কের মূলে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র ফ্যাক্টর।
তিনি বলেন, মস্কো-আঙ্কারার মধ্যে এখন যে মাখামাখি তাকে আমি স্বার্থসিদ্ধির জন্য একটি বিয়ে হিসেবে দেখি। দুটো দেশকেই যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুদিন ধরে একঘরে করার চেষ্টা করছে। ফলে প্রত্যাখ্যাত দুই পক্ষ কাছাকাছি হয়ে স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করছে।
সিরিয়া যুদ্ধ নিয়ে পুতিন ও এরদোয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ একেবারেই মানতে পারেনি ওয়াশিংটন। পরে, সিরিয়ার সীমান্ত অঞ্চল থেকে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট কুর্দি মিলিশিয়াদের সরিয়ে একটি ‘সেফ জোন’ তৈরির জন্য তুরস্কের দাবি প্রত্যাখ্যাত হলে ক্ষেপে যান এরদোয়ান।
হামদী বলেন, নিজেদের ভিন্ন সামরিক-রাজনৈতিক অভিলাষ থাকা স্বত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে পড়া এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মধ্যে অভিন্ন স্বার্থ খুঁজে পায়। যার ফলে, ২০১৫ সালের নভেম্বরে তুরস্ক সিরিয়ায় রুশ যুদ্ধবিমান গুলি করে নামালেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি।
ওই ঘটনার পরপরই, ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থান থেকে রক্ষা পাওয়ার পর এরদোয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। কারণ এরদোয়ানের সন্দেহ, ওই অভ্যুত্থানের পেছনে পশ্চিমাদের ইন্ধন ছিল।
ন্যাটো জোটের একটি দেশের নেতা হয়েও অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ান প্রথমে যে দেশটিতে যান, সেটি ছিল রাশিয়া। সেসময় আঙ্কারা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এতটাই তিক্ত হয়ে ওঠে যে, যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার চুক্তি করেন এরদোয়ান। রাশিয়া-বিরোধী সামরিক জোটের সদস্য হয়েও রাশিয়ার কাছ থেকেই সমরাস্ত্র কিনে রীতিমতো নজির সৃষ্টি করেন তিনি।
রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা
রাশিয়ার ওপর তুরস্কের অর্থনৈতিক নির্ভরতাও ক্রমেই বাড়ছে। তুরস্কের গ্যাসের চাহিদার ৪৫ শতাংশ পূরণ করে রাশিয়া, জ্বালানি তেলের চাহিদার ৩৫ শতাংশও আসে সেখান থেকে। রুশ গমের ওপরও তুরস্ক বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এছাড়া, সংখ্যার বিচারে তুরস্কে এখন রুশ পর্যটকরা এক নম্বরে। এ কারণে, রাশিয়ার ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করার পেছনে এই অর্থনৈতিক নির্ভরতারও যে বড় ভূমিকা ছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
তবে সামি হামদী মনে করেন, তুরস্ক ও রাশিয়ার সম্পর্কের মূলে রয়েছে রাজনীতি। তিনি বলেন, ইউরোপের অনেক দেশের মতো জ্বালানির জন্য তুরস্কও রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এরদোয়ান ও পুতিনের সম্পর্কের প্রধান তাড়না রাজনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক।
এ বিশ্লেষক বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। আবার অতটা কাছাকাছিও হচ্ছে না, যাতে তার গায়ে রাশিয়ার মিত্র তকমা লাগে।
সে কারণে ইউক্রেনকে খোলাখুলি সামরিক ড্রোন বিক্রি করছে তুরস্ক, যা রুশ ট্যাংক ধ্বংস করছে। ইউক্রেনের অনুরোধে কিছুদিন আগে গমভর্তি রুশ জাহাজ আটকও করেছে তারা। পুতিন অসন্তুষ্ট হবেন জেনেও সুইডেন-ফিনল্যান্ডের ন্যাটোয় যোগদানের ব্যাপারে আপত্তি তুলে নিয়েছেন এরদোয়ান।
তবে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টও সমানভাবে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ককে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করছেন বলে মনে করেন সাদি হামদী। তার কথায়, ন্যাটোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশের সঙ্গে এই দহরম-মহরম যুক্তরাষ্ট্রের গায়ে হুল ফোটানোর জন্য পুতিনের হাতে বড় একটি হাতিয়ার। ন্যাটোতে ফাটল রয়েছে এমনটি দেখানোর বড় সুযোগ।
সম্পর্ক টিকবে?
প্রশ্ন হচ্ছে- এই সম্পর্কের ভিত্তি কতটা শক্ত? সম্ভাব্য ঝুঁকি কোথায়? সম্প্রতি লন্ডনের গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে প্রশ্নের উত্তরে তুরস্ক বিশেষজ্ঞ ড. বেইজা উনাল বলেন, সিরিয়া নিয়ে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কে হঠাৎ ফাটল ধরা খুবই সম্ভব।
সিরিয়ার উত্তরে কুর্দি মিলিশিয়াদের তাড়াতে নতুন সামরিক অভিযান নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে কথা বলছে তুরস্ক। কিন্তু ওই এলাকায় রুশ সেনা মোতায়েন রয়েছে। ফলে, পরিস্থিতি যেকোনো সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ২০২০ সালেও সিরিয়ায় রুশ বিমান হামলায় ৩৩ জন তুর্কি সৈন্য মারা গেছেন।
ড. উনাল আরও বলেন, কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার সামরিক গতিবিধি নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগ রয়েছে। সেখানে রাশিয়া প্রভাব বিস্তারের বেশি চেষ্টা করলে তুরস্ক সহ্য করবে না।
অবশ্য ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিরোধ-সংঘাত-মতভেদ আয়ত্ত্বের মধ্যে রাখার সচেতন চেষ্টা করছে মস্কো ও আঙ্কারা। দুই নেতাই নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
তবে সামি হামদী বলেন, পুতিন ও এরদোয়ানের এই সম্পর্ক একেবারেই পারস্পরিক স্বার্থনির্ভর। তার কথায়, দু’জনেরই এখন দু’জনকে দরকার। যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এরদোয়ানের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে, তিনি পুতিনের কাছাকাছি থাকবেন। পুতিনের জন্যও ব্যাপারটি একই। ভালো কোনো বিকল্প তৈরি হলে সম্পর্ক আলগা হতে সময় লাগবে না।