April 28, 2024
জাতীয়লেটেস্ট

পাওনা টাকা ও জমি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে খুন

রাজধানীর শ্যামলীতে গম গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পেছনে পাওনা টাকা ও জমি আত্মসাতের উদ্দেশ্য ছিল বলে জানিয়েছে র‌্যাব। হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী জাকির হোসেনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়ের সূত্র ধরে তাকে টাকা ধার দিয়েছিলেন নিহত শহীদ আনোয়ার (৭২)। সেই টাকা ফেরত চাওয়ায় কাল হয় তার। এর আগে প্রথমবার হত্যাচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয়বার সফল হয় জাকির।

সোমবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মো. জাকির হোসেন (৩৭) ও তার সহযোগী মো. সাইফুলকে (২৬) গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-২।

তিনি বলেন, নিহত আনোয়ার শহীদ ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি গম গবেষণা কেন্দ্রে ১৯৭৬ সালে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন ও ২০০৮ সালে পরিচালক পদমর্যাদার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে সর্বশেষ কর্মস্থল জয়দেবপুর থেকে অবসর নেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতাসম্পন্ন একজন কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরি জীবনের সবটুকু সময় গবেষণা কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, আনোয়ার শহীদ কর্মস্থল ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ও পরোপকারী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৮৩ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও মাসখানেকের মধ্যে তার স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরে তিনি আর বিয়ে করেননি এবং তার কোনো সন্তান নেই। অবসর নেওয়ার আগে ও পরে তার গ্রামের বাড়ি নীলফামারী জেলার ডোমারে বিভিন্ন সময় দরিদ্র ও অসহায় আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন বলে জানা যায়।

তিনি বলেন, অবসরের পর থেকে তিনি ছোট বোন ও মামলার বাদী ফেরদৌস সুলতানার সঙ্গে তার কল্যাণপুরস্থ বাসায় থাকতেন। অবসরের পর পেনশনের টাকা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি দিনাজপুর জেলায় একটি জমি কিনে বাড়ি বানান ও ভাড়া দেন। চাকরিতে থাকতে ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন তিনি। সেখানেই তার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মো. জাকির হোসেনের পরিচয় হয়।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, গত ১১ নভেম্বর নিহত আনোয়ার শহীদ পূর্ব-পরিচিত এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে শ্যামলীর একটি বাস কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হন। ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসার সময় শ্যামলীর হলিলেন গলিতে তিনি দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন।

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে ওই গলিতে মুখে মাস্ক ও মাথায় ক্যাপ পরে এক ব্যক্তি পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল। ভিকটিম আনোয়ার শহীদ প্রধান সড়ক থেকে গলিতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ওই দুর্বৃত্ত তার দিকে এগিয়ে যায় ও পকেট থেকে ছুরি বের করে তাকে ছুরিকাঘাত করে। ভিকটিমকে রাস্তার মাঝখানে পড়ে যেতে দেখে ছুরিকাঘাতের বিষয়টি পথচারীরা বুঝতে পারলে হত্যাকারীকে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।

তিনি আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার জাকির প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান—নিহত আনোয়ার শহীদ দিনাজপুরে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে পরিচয় হয়, যা পরে ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। দিনাজপুরে নিহতের সঙ্গে জমি কেনার সময় জাকির দালাল হিসেবে মধ্যস্থতা করেন। এছাড়াও নিহতের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে জাকির ১২ লাখ টাকা ধার নেন।

তিনি আরও বলেন, ভিকটিমের অবসরের পর ঢাকায় বসবাস শুরু করলেও ঘনিষ্ঠতার সুবাদে জাকিরের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ হতো। এক বছর আগে জাকির তার চালের গোডাউন বন্ধক রেখে ২০ লাখ টাকা লোন পাইয়ে দিতে নিহত আনোয়ার শহীদের সহযোগিতা চান। ভিকটিম তাকে সহযোগিতা করতে অপারগতা জানান এবং তার পাওনা ১২ লাখ টাকা ফেরত দিতে জাকিরকে চাপ দেন। ওই টাকা লেনদেনের ব্যাপারে নিহত আনোয়ার শহীদ ও জাকির ছাড়া কেউ জানতেন না। এরপর জাকির গত ৬/৭ মাস ধরে আনোয়ার শহীদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এতে তার ধারের টাকা ফেরত দেওয়া লাগবে না। জাকির হত্যাকাণ্ডের ৩/৪ মাস আগে একবার আনোয়ার শহীদকে তার পূর্ব-পরিচিত ধান/চালের চাতাল শ্রমিক সাইফুলকে দিয়ে পরিকল্পনা করে ঢাকায় হত্যাচেষ্টা করেন।

গ্রেফতার সাইফুল জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি এক সময় জাকিরের চালের গোডাউন কাজ করতেন। নিয়মিত মাদকসেবন ও কিনতে তার প্রায়শই টাকার প্রয়োজন হতো। জাকিরের গোডাউনে কর্মরত থাকাকালে বিভিন্ন সময়ে জাকির সাইফুলকে অর্থ-সহায়তা করতেন। ৩/৪ মাস আগে জাকির সাইফুলকে ঢাকায় আসতে বললে সাইফুল ঢাকায় আসেন। এসময় জাকির সাইফুলকে বলেন, একজন লোক আর্থিকভাবে তাকে অনেক বড় ধরনের ক্ষতি করেছে, তাকে হত্যা করতে হবে। সাইফুল যদি ওই ব্যক্তিকে হত্যা করে তাহলে জাকির সাইফুলকে জায়গাসহ বাড়ি, অর্থ-সহায়তা দেবে ও আগের ধার করা টাকা পরিশোধ করতে হবে না। সে সময়ে জাকির সাইফুলকে একটি ছুরিও কিনে দেন আনোয়ার শহীদকে হত্যার জন্য। জাকিরের প্ররোচনায় সাইফুল এর আগেও আনোয়ার শহীদকে হত্যাচেষ্টা করেন কিন্তু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও পুলিশের উপস্থিতির কারণে ব্যর্থ হন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সাইফুল ও জাকির উভয়কে জিজ্ঞাসাবাদে জানান, সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনোয়ার শহীদকে হত্যার এই ধারাবাহিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১১ নভেম্বর সকালে জাকির ও সাইফুল দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে কল্যাণপুরে একটি আবাসিক হোটেলে থাকেন। হোটেলের কক্ষে বসে জাকির ও সাইফুল ভিকটিমকে হত্যার সর্বশেষ পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী জাকির হোটেলের পাশের গলির দোকান থেকে ১৮০ টাকা দিয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিটি কেনেন।

ওই দিন সন্ধ্যায় পূর্বনির্ধারিত সময় ও স্থানে ভিকটিম জাকিরের সঙ্গে দেখা করতে এলে প্রয়োজনীয় কেনাকাটার কথা বলে ভিকটিমকে স্থানীয় একটি মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। জাকির কেনাকাটা শেষ করে শ্যামলীর হলিলেন গলিতে ভিকটিমকে নিয়ে আসেন এবং সাইফুলের উদ্দেশ্যে ইশারা দেন। গলিতে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা সাইফুল এসময় ভিকটিম শহীদের কাছে এগিয়ে গিয়ে ছুরিকাঘাত করে দ্রুত পালিয়ে যান। এসময় জাকির ভিকটিমের পাশেই অবস্থান করছিলেন ও সিসিটিভি ফুটেজে ভিকটিমকে হাত ধরে মাটিতে শুইয়ে দিতে দেখা যায়।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, আহত ভিকটিম মাটিতে শুয়ে পড়লে পথচারীরা চারপাশে ঘিরে ধরে এবং এই সুযোগে জাকিরকে ঘটনাস্থল থেকে সরে যেতে দেখা যায়। হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতার জাকির ও সাইফুল হোটেলে ফিরে আসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী পোশাক পরিবর্তন করে দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য হোটেল থেকে বের হয়ে যান। এসময় দিনাজপুর থেকে একজন ব্যক্তি জাকিরকে ফোন দিয়ে আনোয়ার শহীদ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে বলে জানায়। জাকির ও সাইফুলের রাত ৮টার বাসে দিনাজপুরে যাওয়ার কথা থাকলেও এসময় জাকির তার বাসের টিকিট রাত সাড়ে ৯টায় পরিবর্তন করে জাকির সাইফুলকে ৬০০ টাকা দিয়ে দিনাজপুরে চলে যেতে বলেন।

তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে তিনি ভিকটিমকে দেখার জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যান। বিভিন্ন মিডিয়ায় এই হত্যাকাণ্ড ব্যাপক আলোড়ন তুললে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী জাকির ও হত্যাকারী সাইফুল দিনাজপুর ত্যাগ করে বিভিন্ন জায়গা পরিবর্তন করে পালিয়ে থাকে। পরে তাদের রাজধানীর গাবতলী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *