নবাবগঞ্জে দুই মৃত্যুর ঘটনায় পীরও পরিবারের সন্দেহে
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলায় একজনকে কুপিয়ে হত্যা এবং ওই হামলার মধ্যে আরেকজনের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় কথিত এক স্থানীয় পীরের দিকে সন্দেহের আঙুল তুলেছেন পরিবারের সদস্যরা।
তিন দিন আগে উপজেলার গালিমপুর ইউনিয়নের নোয়াদ্দা গ্রামের ওই হত্যাকাণ্ডকে প্রাথমিকভাবে ‘ছিনতাইয়ের ঘটনা’ বলা হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে নিহতের পরিবারের অভিযোগ, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় থানায় একটি হত্যা মামলাও দায়ের করেছেন তারা।
নিহত শেখ কালাম (৫২) নবাবগঞ্জ উপজেলার নোয়াদ্দা গ্রামের মৃত শেখ কদম আলীর ছেলে। কৃষিকাজের পাশাপাশি নিজের বাড়িতে গরুর খামার দিয়ে ব্যবসা করতেন তিনি। আর মো. জাহিদ খান (৪৪) একই এলাকার মৃত মো. ফৌজদার খানের ছেলে। নোয়াদ্দা বাজারে তার ইট, বালু, রড, সিমেন্টের ব্যবসা ছিল।
তারা দুজনেই উপজেলার নয়নশ্রী ইউনিয়নের দেওতলা গ্রামের কথিত পীর নজরুল ইসলাম মোলার অনুসারী। গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে ওই পীরের বাড়ি থেকে মোটর সাইকেলে করে ফেরার পথে আক্রান্ত হন তারা দুজন।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে প্রাথমিকভাবে পুলিশ জানায়, বান্দুরা ইউনিয়নের মহব্বতপুর চাঁদ মসজিদ চকের সামনের সড়কে কলাগাছ ফেলে কালাম ও জাহিদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করা হয়। পরে অন্তত তিনজন হামলাকারী ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর হামলা করে।
যেখানে কলাগাছ ফেলে মোটরসাইকেলের পথ আটকানো হয়েছিল, সেখান থেকে আরও দেড়শ গজ দূরে সড়ক থেকে কালামের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রোববার সেখানে গিয়ে রাস্তায় রক্তের শুকনো দাগ দেখা যায়।
পুলিশ বলছে, কালামকে কুপিয়ে এবং সর্বশেষ গলাকেটে হত্যা করার চিহ্ন ছিল তার শরীরে। আর জাহিদের হাতে সামান্য জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়। হামলার মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয় বলে চিকিৎসকদের ধারণা।
জাহিদের বড় বোন তৌফিকা খানম রোববার বলেন, তার ভাইয়ের মৃগী রোগ ছিল। অনেক চিকিৎসা নেওয়ার পরও কোনো লাভ হয়নি। কয়েক বছর আগে ওই পীরের সন্ধান পাওয়ার পর তাকে কাছে গিয়ে সুফল পান জাহিদ। এরপর তিনি পীরের ভক্ত হয়ে যান।
তৌফিকা জানান, জাহিদ প্রতি সোমবার অথবা বৃহস্পতিবার কথিত পীর নজরুল মোলার বাড়িতে যেতেন। কখনও কখনও সপ্তাহে দুই দিনও যেতেন। পীরবাবা সামনে দিয়ে কিছু না নিলেও উনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার ভাই গরু, মহিষসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে দিতেন। ভাই প্রশংসা করে আমাদের বলত, পীরবাবা নাকি আসনে বসে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেন, বলে দিতে পারেন কার বাড়িতে কী হচ্ছে।
উনি যদি আসনে বসে সত্যিই বলে দিতে পারে যে কোথায় কী হবে, তাহলে সেদিন সন্ধ্যার পর কী হবে, বাড়ি ফেরার পথে জাহিদ আর কালামের ওপর হামলা হবে- ওরা হামলায় মারা যাবে- এসব কি তাহলে উনি দেখতে পাননি?
তৌফিকা বলেন, রাত ১১টার দিকে জাহিদ যখন কালামকে নিয়ে মোটর সাইকেলে করে বাড়ির পথে হওনা হল, তখন পীরবাবা কেন বললো না যে পরে রওনা দে, আসনে বসে একটু দেখে নিই পথে কোনো বিপদ আছে কিনা। এমনকি পীরবাবা বা তার ছোট ভাই আমার ভাইয়ের জানাজাতেও আসেনি। দাফনের সময়ে শেষবার দেখতেও আসেনি। তাদের আমরা সন্দেহের বাইরে রাখতে পারছি না।
হামলাকারীরা যদি ছিনতাইকারীই হয়ে থাকে, তাহলে জাহিদের মোটরসাইকেল বা তাদের সঙ্গে থাকা হাজার ছয়েক টাকা আর মোবাইল ফোন কেন নিল না- সেই প্রশ্ন তুলেছেন তৌফিকা। তিনি বলেন, এতেই প্রমাণ হয় যে হামলাকারীরা ছিনতাইকারী ছিল না। পরিকল্পিতভাবে আমার ভাই আর কালামের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। আমি খুনিদের ফাঁসি চাই।
নিহত কালামের মেয়ে শান্তা ইসলাম বলেন, ছিনতাইকারীরা নয়, কেউ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। ছিনতাইকারী হলে সব কিছু নিয়ে যাবে; তারা তো কিছুই নেয়নি। আমরা দ্রুত খুনিদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
আর কালামের স্ত্রী যমুনা বেগম বলেন, আমার স্বামীকে যারা অমানুষের মত কুপিয়ে মেরেছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই। এ ঘটনায় নিহত শেখ কালামের ছেলে আব্দুল রাজ্জাক বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় তিনজনকে আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
নবাবগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, তদন্ত চলছে। তারা ছিনতাইকারীর হামলার শিকার বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
স্বজনদের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে কথিত পীর নজরুল ইসলাম মোলা বলেন, আমি কাউকে ঝার ফুক করি না, কোনো দাওয়াইও দিই না। আমার দরবারে নামাজ আদায় এবং তসবি পড়ে আমল করে আলাহর কাছে দোয়া করা হয়। আলাহ যদি দোয়া কবুল করে কোনো পাপী বান্দার ভালো করে, সেটাই আমার পাওয়া। আমি কারও কাছ থেকে কোনো হাদিয়া বা টাকা-পয়সা নিই না।
নজরুল মোলা বলেন, তার ‘দরবারে’ প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার ‘আমল’ হয়। তাতে অংশ নিতেই গত বৃহস্পতিবার ইফতারের আগে কালাম ও জাহিদ তার বাড়িতে যান। ইফতার করে তারা দরবারে বসে আমল করে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে কালামকে রেখে জাহিদ আমার ছোট ভাই খোকনের সাথে স্থানীয় এক নেতার বাড়িতে যায় সালিশে অংশ নিতে। পরে রাত ১১টার দিকে ওরা ফিরলে জাহিদ আর কালাম তাদের বাড়ির পথে রওনা হয়।
কিছুক্ষণ পর আমার ছোট ভাইয়ের মোবাইলে ফোন আসে যে মহব্বতপুর চকের সড়কে ওরা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছে। ঘটনা শোনামাত্র আমার ছোট ভাই পুলিশকে ফোন করে বিষয়টি জানায়। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই।
নজরুল মোলার দাবি, জাহিদ ও কালাম তার ‘অনেক কাছের’ ছিলেন। এভাবে তাদের মৃত্যু তিনি মানতে পারছেন না। ওরা শুধু আমার আশেকান ভক্ত ছিল না, ওরা আমার ছেলে ছিল। আমার নিজের সন্তান মারা গেলেও এত কষ্ট পেতাম না।
নবাবগঞ্জ থানার ওসি মোস্তফা কামাল বলেন, পরিবারের সঙ্গে কথা বলার পর তারা কথিত পীর নজরুল মোলা ও তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে কাউকে গ্রেপ্তারের পর্যায়ে এখনও তারা যাননি।