April 27, 2024
জানার আছে অনেক কিছুলেটেস্ট

জাপানের মানুষজন [Japanese People, 日本人] – প্রফেসর ড. মো: মতিউল ইসলাম

জাপানের মানুষ জন (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

হোননে/তাতেমাএ (ほんねたてまえ) [মনের ভাব ও প্রকাশিত রূপ] {one’s true feelings and the public face}

আমার সন্তানের জন্ম হয়েছে জাপানে, সাগা প্রিফেকচারের একটা হাসপাতালে। অনেক জটিলতা মাথায় নিয়ে একটানা ১৩ ঘন্টা চেষ্টার পরে ডাক্তাররা আমার সন্তানের ‘নরমাল ডেলিভারি’ সফল করাতে পারলেন। আমার স্ত্রীকে ‘লেবার রুম’-এ নেওয়ার পর দেখলাম সেখানে নতুন এক ডাক্তার, যিনি এর আগে আমার স্ত্রীর প্রেগনেন্সি পিরিয়ডে কোনোদিন তাঁর চেহারা দেখাননি! জিজ্ঞাসা করে জানলাম তিনি একজন ‘অবস্টেট্রিসিয়ান (obstetrician)’। প্রেগনেন্সি পিরিয়ডের ডাক্তার ছিলেন ‘গাইনিকোলজিস্ট (gynaecologist)’! এই প্রথম আমি জানলাম এঁরা দুইজন আলাদা ‘মামা’। বাংলাদেশের মতো two-in-one ‘মামা’ নন! ছেলে পৃথিবীর আলো দেখার পরই আমাকে আর আমার স্ত্রীকে এক ঝলক দেখিয়ে আরেকজন ডাক্তার তাঁর কব্জায় নিয়ে নিলেন। তিনি হলেন ‘পেডিয়াট্রিসিয়ান (paediatrician)’। সব আলাদা আলাদা মামা (ডাক্তার)-র কারবার! ধান ভাণতে একটু শিবের গীত গেয়ে নিলাম আর-কি! জাপানের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আরেকদিন গল্প করবো! রকম রকম ডাক্তার নিয়ে আমার আজকের গল্প নয়!

ডাক্তার বার বার পরিবর্তন হলেও একজন নার্সকে শুরু থেকেই আমার স্ত্রীর পাশে দেখলাম! ভোর চারটা থেকে বিকাল পাঁচটা (১৩ ঘন্টা) পার হয়ে যাওয়ার পরে রাতেও দেখি সে-ই নার্স আমার স্ত্রীকে ওষুধ খাওয়াতে এসেছেন। মহিলায় মহিলায় ভালো জমে! ভাষা সেখানে কোনো ব্যারিয়ার হতে পারেনা! আমার স্ত্রী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে করতে গল্প জুড়ে দিলেন (শরীর প্রচন্ড খারাপ থাকা স্বত্তেও)! সেই নার্সও হাসি কান পর্যন্ত বিস্তৃত করে উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন! এতো দীর্ঘ সময় তিনি হসপিটালে আছেন কেনো জিজ্ঞাসা করাতে জানা গেলো যে, তিনি ধাত্রী বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন অভিজ্ঞ নার্স তাই তাঁকে সন্তান প্রসবকালীন সময়ে ডিউটি করতে হয়েছে। আর তাছাড়া ঐ সপ্তাহের ঐ সময়টাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক নার্স ‘অন-স্টেশন’ না-থাকাতে তাঁকে অতিরিক্ত সময় ডিউটি করতে হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় তিনি একফোঁটা ঘুমাননি। তিনি এতোটাই ক্লান্ত যে, কান্তি দূর করতে অনবরত এনার্জি ড্রিংক/কফি খেয়ে যাচ্ছেন। সকাল বেলায় (১০ টা নাগাদ) আরেকজন আসলে তিনি দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করবেন। শরীরের ভেতর অথবা মনের ভেতর যে ঝড়ই বয়ে যাক না কেনো জাপানিজরা মুখের এক্সপ্রেশনে তা প্রকাশ হতে দেবেই না! এটাই হচ্ছে- “হোননে/তাতেমাএ (ほんね – たてまえ) [মনের ভাব ও প্রকাশিত রূপ] {one’s true feelings and the public face}” বৈশিষ্ট্য।

এটা জাপানিজদের [আমার লেখায় বর্ণিত ১ম বৈশিষ্ট্য “ওয়া (わ) [ঐকতান] {harmony of the Japanese mentality}”] চারিত্রিক-মানসিক বহিঃপ্রকাশ এর ধারাবাহিকতা মাত্র। The Japanese people value ‘tatemae (public face and expression)’ more than ‘honne (one’s true feelings)’. The Japanese people try not to hurt or anger others by telling ‘honne’.

আরেকটা গল্প বলি। ২০১৫ সালের দিকে আমার ল্যাব (ট্রপিক্যাল ক্রপ ইম্প্রুভমেন্ট ল্যাব) এর আন্ডারগ্র্যাড স্টুডেন্টদের থিসিস ডিফেন্স চলছে। দেখলাম একজন ছাত্রী থিসিস ডিফেন্সে আসেনি। আমি খুব অবাক হলাম! কারণ, আমি দেখেছিলাম সেই মেয়েটি খুব যত্ন করে মনোযোগ দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছে, থিসিস লিখেছে, প্রেজেন্টেশন বানিয়েছে, প্র্যাকটিসও করেছে! কিন্তু ফাইনাল ডিফেন্সে আসলো না কেনো!? আমি কৌতুহল চেপে রাখতে না-পেরে আমার ল্যাবের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঘটনাটা কী?’। তিনি সিম্পলি বললেন ‘ওর একটু সমস্যা হয়েছে। তাই ‘ও’ ফেয়ারওয়েল ইভনিং এর দিন সকালে থিসিস ডিফেন্স করবে, এবং সেটা আর ৫ দিন পরেই অনুষ্ঠিত হবে’। ফেয়ারওয়েল ইভনিং এর দিন চলে আসলো। সকালে দেখি খিলখিল করে হাসতে হাসতে মেয়েটি থিসিস ডিফেন্স করলো, সারা বিকাল সবার সাথে হেসে হেসে গল্পগুজব করলো, সবার সাথে ছবি তুললো, সময়মতো থিসিস ডিফেন্স করতে না-পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলো! শুধু আমি মুখ কালো করে সারাটা সময় বিমর্ষ কাটিয়ে দিলাম! কারণ, আমি মেয়েটিরই একজন সহপাঠির কাছ থেকে জেনে গিয়েছিলাম যে, থিসিস ডিফেন্সের আগের দিন ফুকুওকা শহরে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় মেয়েটিরে ‘মা’ মারা গিয়েছিলো।

এখন বলেন তো, আমরা কী করি?! কমেন্ট বক্সে উদাহরণসহ অভিজ্ঞতা লিখুন… হা… হা… (এই “হা… হা…” কমেন্ট লিখতে বলে বিব্রত করার জন্য দুঃখ প্রকাশের হা..হা..– না, মানে বিব্রতভাব কমিয়ে আনার হা.হা.)

[বি.দ্র. উপরে বর্ণিত সকলের ছবি আমার কাছে আছে। দুঃখিত সেগুলি দিতে পারলাম না!]

কেনকিইয়ো けんきょ [বিনয়] {modesty}

ছোটবেলায়, যখন হাই স্কুলে উঠেছি, ইংরেজি গ্রামার (আমরা বলতাম ‘ইংরেজি ২য় পত্র’; লেখাপড়ার ২য় horror-show; ১ম টা হচ্ছে ‘গণিত’) ক্লাসে এসে একদিন হেড-স্যার ‘Letter-Application’ পড়ালেন। তিনি আমাদের পরের ক্লাসের জন্য একটা ‘application for leave of absence’ মুখস্থ করে আসতে বললেন। ক্লাসে কয়েকবার রিডিং পড়িয়েও দিলেন- “Sir, I beg most respectfully to state that…; তারপর- I humbly pray and hope that, your honor would be kind enough…”। তখন, ‘humble’ শব্দটা প্রথম শুনলাম ও শিখলাম! কিন্তু এর তাৎপর্যসহ অর্থ কী তা বুঝতে পারলাম না! কেউ বুঝিয়েও দিলো না! তারপর, অন্য আরেকদিন ‘রায় স্যার’ ট্রানস্লেশন শিখালেন- ‘ছেলেটি বিনয়ী – The boy is modest.’ নতুন আরেকটি শব্দ ‘modest’ শিখলাম। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে, আমাদের দেশে, এগুলো নতুন শব্দ হিসেবে শেখার ভিতরেই সাধারণত সীমাবদ্ধ থাকে। বিচ্ছিন্নভাবে ‘পরিবারে’ কোনো কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ; অথবা কালেভদ্রে ‘স্কুলে’ কোনো কোনো নমস্য শিক্ষক (যাঁদের সংখ্যা ক্রমশঃ নিম্নগামী) এসব ‘modesty’, ‘humbleness’ এর কথা বলেন বা শিখানোর চেষ্টা করেন! এসব বিষয় শেখানোর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ আমাদের দেশে নেই। কিন্তু জাপানিজদের চরিত্রের চোখে পড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে “কেনকিইয়ো (けんきょ) [বিনয়] {modesty}”।

জাপানে modesty’র আলাদা আরেকটি অর্থও আছে। ‘Kenkyo’ (modesty) is a modest attitude of refraining from overly showing off or boasting one’s ability. দেখা গেলো কি যে, বিরাট বড়ো এক বিজ্ঞানী বলছেন, ‘জ্ঞানের সাগরে আমি খড়কুটো কুড়িয়েছি মাত্র’! Modesty is one of the concepts of ‘Wa (harmony)’ in which one is urged to assume an amenable attitude in learning about things by understanding one’s own shortcomings. এই জন্য জাপানে কারও ভুল হলে কেউ হাসে না! কোনো শিক্ষক কোনো শিক্ষার্থীকে কোনোদিনও বলে না যে, ‘তুমি এইটাও জানো না!?’। কেউ ভুলেও বলে না যে, ‘তুমি আমার চেয়ে বেশি জানো!?’। কেউ আত্মপ্রচার করে না। কেউ নিজেকে বড়ো হিসেবে উপস্থাপন করার ন্যূনতম চেষ্টাও করেনা।

জাপানে পড়াকালীন সময়ে আমার ল্যাবের একজন জাপানিজ স্টুডেন্ট (ওয়েস্টার্ন কালচারের ভক্ত) বলতো- “জাপানিজরা সরাসরি কিচ্ছু বলতে পারে না!” ‘না’-ও বলতে পারে না, ‘হ্যাঁ’-ও বলতে পারে না! ‘যাবো’-ও বলতে পারে না, ‘যাবো না’-ও বলতে পারে না। শুধু বলে ‘がんばります (Ganbarimasu)- I’ll do my best’ [বাংলাদেশি ২০০% sure-এর চেয়েও বেশি দৃঢ়]।

একটা গল্প বলি। একদিন একটা নাইট-ক্লাবে গিয়েছিলাম। সেখানে যেয়ে একটা ছেলের সাথে পরিচিত হলাম। ছেলেটা সাগা ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির এমবিবিএস ৫ম বর্ষের ছাত্র। ওর সাথে গল্প করার ফাঁকে একসময় একটা মেয়ে এসে ওর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলো। ছেলেটা মেয়াটাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। আমার সাথেও কিছু আলাপ হলো। মিনিট কয়েক পরে আরেকটি ছেলে (মেয়েটির নতুন বয়ফ্রেইন্ড) এসে মেয়েটিকে নিয়ে গেলো। সে-ও একটু কথাবার্তা বলে গেলো! সবাই আমরা হাসিখুশি ছিলাম। মেয়েটা চলে যাওয়ার পরে ঐ ছেলেটি জানালো যে, কথা বলে যাওয়া মেয়েটি আগে তার গার্লফ্রেইন্ড ছিলো। অল্প কিছুদিন আগে তারা আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু কারও প্রতি কারও কোনো অভিযোগ নেই, রাগও নেই। একে অপরের চয়েসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আচরণে যারপরনাই “বিনয়ী”। এইটাই জাপানিজ স্টাইল! ঘটনাটা জানার পরে আমি মনে-মনে কল্পনা করলাম, আলাদা হওয়ার জন্য ছেলে অথবা মেয়েটা কী বলেছিলো— ‘জানো, আমার না মনে হচ্ছে যে, আমি তোমার প্রতি অবিচার করছি! আমার চেয়েও ভালো সঙ্গী পাওয়ার যোগ্যতা ও অধিকার তোমার আছে। তোমার জন্য নিরন্তর শুভকামনা’…

মানুষ গল্প শুনতে ভালোবাসে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ গল্প বলতে পারেনা। পাঠক (অথবা শ্রোতা) সৃষ্টি করা ও ধরে রাখার মতো অনবদ্য গুণ খুব কম সংখ্যক মানুষের (লেখকের) মধ্যেই আছে। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তাই আমিও বেশিরভাগ মানুষের দলে।

আজকে জাপানিজদের “নেমাওয়াশি (ねまわし) [পূর্ব পরামর্শ/আলোচনা]” বৈশিষ্ট্য নিয়ে গল্প করবো।

নেমাওয়াশি (ねまわし) [পূর্ব পরামর্শ-আলোচনা] {prior consultation/agreement for the smooth conduct of business/work}

একটু কৃষি বিজ্ঞান পড়া যাক। আমরা যদি কোনো গাছের চারা লাগাতে চাই তাহলে কী করি?

[ক] আগে পছন্দসই জাতের গাছের চারা সংগ্রহ/উৎপাদন করি। চারার পরিচর্যা করে চারাকে রোপণের উপযুক্ত করি। চারার বয়স, স্বাস্থ্য, প্রত্যক্ষভাবে বাড়তে থাকা তরুণ মূলের সংখ্যা, ইত্যাদি ঠিক আছে কি-না দেখে নিই।

[খ] তারপর চারার জন্য নির্ধারিত স্থানে উপযুক্ত মাপের গর্ত তৈরি করি। গর্ত আলগা রেখে আলো-বাতাস লাগিয়ে ক্ষতিকর বালাই মুক্ত করি। সেখানে উপরের মাটি নিচে, নিচের মাটি উপরে দিই।

[গ] গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি-উপাদান মিশাই। তারপর কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে গাছের চারাটা রোপণ করে পানি দিই, হেলে পড়া রোধ করতে খুঁটি পুঁতে চারা-গাছটাকে আলতো করে বেঁধে দিই।

আচ্ছা, কেউ যদি [খ] রেডি করার আগেই গাছের চারা তুলে নিয়ে যায় আর [খ] ও [গ] এর কাজ করতে শুরু করে, তাহলে কী হতে পারে!? পছন্দের গাছের চারাটি মারা যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়, অথবা মারা যায়!

‘নেমাওয়াশি’ শব্দটা আসলে ‘বাগান করা’ সম্পর্কিত একটা জাপানিজ টার্ম। এর মানে হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর শিকড়-বাকড় কেটে-ছেঁটে দেওয়া যাতে নতুন করে নতুন শিকড় গজাতে ও বাড়তে কোনো প্রতিবন্ধকতা না সৃষ্টি হয়।

জাপানিজরা গাছের চারা রোপণের এই কাজের মতো তাদের সব কাজও খুব ভেবে-চিন্তে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে তারপর সম্পন্ন করে। এটাই “নেমাওয়াশি (ねまわし) [prior-consultation, পূর্ব পরামর্শ/আলোচনা] {prior agreement for the smooth conduct of business/work}” বৈশিষ্ট্য। আমার জানা ও দেখা মতে জাপানিজরা ‘homework’ না-করে ‘whimsically’ কোনো কাজ করেনা!

বাংলাদেশে আমরাও ‘নেমাওয়াশি’ চর্চা করি! মিটিং-এর আগে মিটিং করে অনেক কিছু ঠিক করি। অনেক সময় ফোনে কথা বলি! প্রয়োজন হলে দেখাও করি! কিন্তু বেশিরভাগ সময় উদ্দেশ্য থাকে ‘কাউকে জব্দ করা’, ‘অবৈধ কোনো কিছু বাস্তবায়ন করা’, ‘ঘুষ প্রদান করে অনৈতিকভাবে কাজ বাগিয়ে নেওয়া’, ‘ভয়ভীতি প্রদর্শন করা’, ‘স্বজনপ্রীতি নিশ্চিত করা’, ‘কোম্পানি/প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের বাইরে নিজের স্বার্থ হাসিল করা’…

এরকম বলতে থাকলে কয়েক পৃষ্ঠা লেখা হয়ে যাবে। তাই এটা বাদ দেওয়া যাক…

এই ক’দিন শুধু জাপানিজ মানুষদের বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছি। আজ বলবো সরাসরি মানুষের কথা- ‘জাপানিজ সম্রাট’-দের কথা…

তেননো (てんのう) [সম্রাট] {symbol of the Japanese state and the unity of the Japanese people}

১৯০১ সালের ২৯ এপ্রিলে জাপানের টোকিওতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ‘মিচিইয়ামা হিরোহিতো’ (Michinomiya Hirohito) নামে এক ব্যক্তি। রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করার সুবাদে তিনি জাপানের ১২৪তম সম্রাট (てんのう-Emperor) হিসেবে অভিষিক্ত হন। তিনি ২৫/১২/১৯২৬ খ্রি. থেকে ২/৫/১৯৪৭ খ্রি. পর্যন্ত জাপান শাসন করেন (ruling over the Empire of Japan)। তার মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জাপানের শাসনকর্তা ছিলেন। তারপর থেকে ১৯৮৯ সালের ৭ জানুয়ারিতে মৃত্যুবরণ করার আগ পর্যন্ত তিনি জাপানের সম্রাট (Emperor of the state; “সরকার সম্পর্কিত কোন ক্ষমতা” নেই ) ছিলেন। তিনি ছিলেন longest-reigning historical Japanese emperor. তাঁর সম্রাট থাকাকালীন সময়কে জাপানে ‘Shōwa era’ বলা হয়।

পরবর্তীতে তাঁর বড় ছেলে ‘Tsugu Akihito’ [ৎসুগু আকিহিতো] জাপানের ১২৫ তম Emperor of the state হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন [৭/১/১৯৮৯ খ্রি. থেকে ৩০/৪/২০১৯ খ্রি. পর্যন্ত]। তাঁর সম্রাট থাকাকালীন সময়কে জাপানে ‘Heisei era’ বলা হয়। তিনি এখনও বেঁচে আছেন (জন্মঃ ২৩/১২/১৯৩৩ খ্রি.; বয়সঃ ৮৭+)। প্রথা ভেঙ্গে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন legendary first emperor of Japan and founder of the imperial dynasty “Jimmu Tennō” [পুরো নামঃ Kow-yamato-iware-hiko No Mikoto] এঁর 125th direct descendant.

১ মে ২০১৯ খ্রি. থেকে নতুন (১২৬তম) Emperor of the state হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ‘Hironomiya Naruhito’ [হিরোনোমিইয়া নারুহিতো], জন্ম ২৩/২/১৯৬০ খ্রি.। তিনি ‘ৎসুগু আকিহিতো’-র বড় ছেলে। তাঁর সম্রাট থাকাকালীন সময়কে জাপানে ‘Reiwa era’ বলা হবে।

[এসব ‘era’ নাম নিয়ে পরে গল্প বলবো।]

ইতিহাস পড়তে পড়তে সব্বাই ক্লান্ত। এবার ‘হিরোহিতো’ সম্রাট (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যিনি জাপানের শাসনকর্তা ছিলেন) এঁর গল্প বলা যাক।

২০১৫ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে জাপানের ৭০তম আত্মসমর্পণ দিবস উপলক্ষ্যে ‘Emperor Hirohito’-কে নিয়ে ৫ টি মিথ (Myth- a widely held but false belief or idea) সংক্রান্ত একটি খবর ‘TIME’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিলো। সেখানকার বর্ণনা অনুযায়ী মিথ পাঁচটি এরকমঃ (১) সম্রাট ‘হিরোহিতো’ দেবতা ছিলেন, (২)‘হিরোহিতো’ সাংবিধানিক পুতুল দায়িত্বে ছিলেন এবং তাঁর জেনারেলদের চাপাচাপিতে যুদ্ধে জড়িয়েছিলেন, (৩)‘হিরোহিতো’ একজন শান্তিপ্রিয় বৈজ্ঞানিক ছিলেন যাঁর আগ্রহের বিষয় ছিলো সামুদ্রিক জীবজগৎ, (৪)‘হিরোহিতো’ নানকিং ধর্ষণ ও চীনে গণহত্যা সংঘটন বিষয়ে কিছুই জানতেন না, ও (৫)‘হিরোহিতো’ Pacific War যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। [এগুলোর প্রত্যেকটি নিয়ে আলাদা আলাদা গল্প হতে পারে!]

১৯৮৯ সালের ৭ জানুয়ারি তারিখে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ (Section 1, Page 6) ‘Emperor Hirohito’-কে নিয়ে আরেকটি খবর প্রকাশিত হয়েছিলো- ‘A Leader Who Took Japan to War, to Surrender, and Finally to Peace’ [লিংকঃ কমেন্ট বক্স ২]। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ‘Emperor Hirohito’ বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া শুধু ধ্বংস ডেকে আনবে, রক্তপাতের ধারা ও নিষ্ঠুরতাকে দীর্ঘায়িত করবে। আমি আমার নিরপরাধ সাধারণ মানুষদের এই দুর্দশা দীর্ঘায়িত হতে দিতে পারিনা। সময় এসেছে অপ্রত্যাশিত (পরাজয়কে) কে মেনে নেওয়ার। অশ্রু সংবরণ করে আমি প্রতিপক্ষ শক্তির কাছে ‘পরাজয়’ স্বীকার করার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি।’

জেনারেল ম্যাকআর্থার (General MacArthur) [Chief of Staff of the United States Army during the 1930s, and played a prominent role in the Pacific theater during World War II] বলেছেন, ‘মলিন সাধারণ কাপড়ে এসেছিলেন ‘Emperor Hirohito’। তিনি গর্বিত-উচ্চশির জেনারেলের সামনে ছিলেন ন্যুব্জ ও ভারাক্রান্ত।’ জেনারেল ম্যাকআর্থার স্মৃতিচারণ করে আরও বলেছেন, ‘‘Emperor Hirohito’ বলেছিলেন, আমি তোমাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে এসেছি। আমি আমার রাজনৈতিক এবং সামরিক সকল সিদ্ধান্তের ও যুদ্ধ পরিচালনার দায় নিচ্ছি (তোমরা আমার দেশের সাধারণ মানুষদের আর কোনো ক্ষতিসাধন কোরো না)।’ যুদ্ধ পরবর্তী অরাজক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য জেনারেল ম্যাকআর্থার ‘Emperor Hirohito’-কে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন। পরবর্তীতে ‘হিরোহিতো’-র ব্যক্তিত্বে তিনি রীতিমত মুগ্ধ হয়েছিলেন।

নিজের রাজ্যের প্রজাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য পরাজয় মেনে নেওয়ার মতো দুঃসাহস খুব কম সম্রাটই এই পৃথিবীতে দেখিয়েছেন। ‘Emperor Hirohito’ সেরকম একজন প্রজাপ্রিয় সম্রাট ছিলেন।

জাপানের সম্রাট হলেন জাপান রাষ্ট্রের প্রধান। ১৯৪৭ সালের সংবিধান অনুযায়ী, তিনি “রাষ্ট্র ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক” এবং তাঁর “সরকার সম্পর্কিত কোন ক্ষমতা” নেই। ঐতিহাসিকভাবে, তিনি শিন্তৌ ধর্মের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। জাপানি ভাষায় সম্রাটকে তেননো (てんのう) বলা হয়, যার অর্থ “স্বর্গীয় সার্বভৌম”।

সাধারণতঃ রাজ-পরিবারের পুরুষ সদস্যগণ সম্রাট হিসবে আবির্ভূত হলেও এখন অনেক জাপানিজ মানুষ চাচ্ছেন রাজ-পরিবারের নারী সদস্যগণকেও এই মর্যাদা দেওয়া শুরু করা উচিৎ।

লেখায় তথ্য বেশি, গল্প কম… দুঃখিত

শেয়ার করুন: