May 2, 2024
জানার আছে অনেক কিছুলেটেস্ট

জাপানের মানুষজন [Japanese People, 日本人] – প্রফেসর ড. মো: মতিউল ইসলাম

৪। গিরি (ぎり) [মানবিক ঋণের কৃতজ্ঞতা] {debt of gratitude; reason of justice in human relationships}

The path of righteousness for things. কোলকাতার একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ এর ১৯৯৭ সালে রিলিজ করা একটা বিখ্যাত সিনেমার নাম ‘দহন’। সেখানে একজন পরিবহণ শ্রমিক কর্তৃক কুড়িয়ে পাওয়া অনেকগুলো টাকা প্রকৃত মালিকের বাসায় ফেরত দিতে আসার একটা সিকোয়েন্স আছে! সেই সিকোয়েন্সে দেখা যায় যে, বাসার সকলে সে-ই পরিবহণ শ্রমিকের এই কাজের জন্য যারপরনাই আপ্লুত ও উদ্বেলিত হয়ে যাচ্ছে। তখন সেই পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য ‘দাদী’ বলেন যে, এটা আসলে আপ্লুত হওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। কারণ সে খুব ‘স্বাভাবিক’ একটা কাজ করেছে। যেটা হওয়া উচিৎ সেটাই করেছে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়, কিন্তু এর জন্য অতি আপ্লুত ও আহলাদিত হওয়ার কিছু নেই। তাকে উপহার-উপঢৌকন দেওয়ারও কিছু নেই! সে টাকাটা ফেরত দিতে না-আসলেই বরং তার কাজটা সঠিক হতো না!

বিবেক দ্বারা চালিত হয়ে সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত মানবিক কাজ করার যে চর্চা সেটাই হচ্ছে ‘the path of righteousness for things’।

Reciprocation of gratitude from others. যে উপকারকারীর উপকার করে সে ‘কৃতজ্ঞ’। যে উপকারকারীর উপকার স্বীকার করে না সে ‘অকৃতজ্ঞ’। যে উপকারকারীর অপকার করে সে ‘কৃতঘ্ন’। আচ্ছা, যিনি আপনার উপকার করেছেন  আপনি কি বিনিময়ে তাঁর কোনো উপকার করেছেন?! বাংলাদেশে একটা কথা প্রচলিত আছে- কারও দ্বারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ক্ষতিকারককে ক্ষতির স্বীকার ব্যক্তি প্রশ্ন করেনঃ ‘আমি কি আপনার কোনো উপকার করেছিলাম?’ জাপানিজরা এমনিতেই আপনার উপকার করার জন্য মুখিয়ে থাকেন! আর যদি কোনোভাবে কোনোদিন আপনি কারও উপকার করে ফেলেন, তাহলে দেখবেন তিনি আপনার জন্য কী কী করেন! এটাই হলো গিরি (ぎり) [মানবিক ঋণের কৃতজ্ঞতা]।

‘Giri’ is a Japanese code of conduct, one of the uniquely practiced Japanese concepts that non-Japanese people find difficult to understand. –Sachiko Horiguchi

আমি তো কোনো রকমে শব্দ-বাক্য দিয়ে ব্যাপারটাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম! কিন্তু গিরি (ぎり)-র তাৎপর্য আরও গভীরের বিষয়, যেটা লিখে প্রকাশ করা কঠিন। যেমনঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ‘ঐশ্বর্য রায়’ কে দেখে আমি কেমন প্রেম অনুভব করতাম তা-কি আমি লিখে প্রকাশ করতে পারবো?! হা… হা…

এর আগে জাপানিজদের ৪ টা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। আজ ৫ম টা বলবো। ফেইসবুকের পাতায় পাতায় বিচরণকারী মানুষদের অবশ্য পড়ার সময়ের খুবই অভাব! তাতে কি!? লেখা চলতে থাকবে…

৫। নিনজো (にんじょう) [মানুষের জন্য ভালোবাসা, মানবিক অনুভূতি] {unrestrained, overflowing feeling of love}

আচ্ছা, আপনি কি কখনও ভালো মানুষ দেখেছেন?!

ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়া কিন্তু খুব কঠিন! হরহামেশাই আমরা ‘ভালো’ আর ‘দক্ষ’ এই দু’টো জিনিসের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলি! একটাকে আরেকটার স্থানে ব্যবহার করি! যেমন দক্ষ শিক্ষককে আমরা কখনও দক্ষ শিক্ষক বলিনা, বলি- ভালো শিক্ষক! আপাতঃ দৃষ্টিতে দেখেই আমরা মূল্যায়ন করে “ভালো” রেজাল্ট দিয়ে ফেলি! কিন্তু শিক্ষক ভালো কি-না সেটা তার ছাত্রছাত্রীরা বলতে পারবে! অন্য কেউ নয়! তেমনই স্বামী ভালো কি-না তা তার স্ত্রী বলতে পারবে (আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি- এই পৃথিবীতে একটাও জীবিত ‘ভালো’ স্বামী নেই! 😜😁 হা… হা…)!

ভালো মানুষ হতে হলে তার ভিতর ভালোবাসা-র “ভালো”-টুকু অবশ্যই থাকতে হবে! এই ভালোবাসা কিন্তু সহপাঠি বন্ধুর প্রেমিকার জন্য ভালোবাসা না! অথবা, বড় ভাইয়ের বন্ধুর জন্যও ভালোবাসা না! এই ভালোবাসা হচ্ছে- সকল মানুষের জন্য, সকল প্রানী ও উদ্ভিদের জন্য, কোনো রকম স্বার্থপরতা ছাড়াই সমানভাবে উৎসারিত!

এবার বলেন তো, আপনি কি ভালো মানুষ?!

জাপানিজদের মধ্যে [বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া] সকল মানুষের জন্য সমানভাবে উৎসারিত ভালোবাসা “নিনজো (にんじょう) [মানবিক অনুভূতি] {unrestrained, overflowing feeling of love}” দেখতে পাওয়া যায়। অনেকে সমালোচনা করেন এই বলে যে, “ওরা ওপর-ওপর ভালোবাসা দেখায়; মন থেকে নয়!” আচ্ছা, কেউ কি মনের শল্য চিকিৎসা করে দেখে এসেছেন যে, ওদের মনে কি আছে?!

শুধু এই “নিনজো (feeling of love)”-ই শেষ কথা নয়, জাপানিজরা এটাকে “গিরি (obligation of gratitude)” যুক্ত করে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। মানে হচ্ছে, জাপানিজ সংস্কৃতিতে সকলের জন্য “ভালোবাসা” হচ্ছে “বাধ্যবাধকতা”-র একটি বিষয়; কেউ এটাকে অস্বীকার অথবা অবজ্ঞা করতে পারবে না! জাপানিজ সমাজে আপনি যদি উঁচু মাপের গুণী মানুষ হতে চান, তাহলে অবশ্যই “গিরি-নিনজো” গুণের অধিকারী হতে হবে! [Both ‘ninjou’ and ‘giri’ are of utmost importance in Japanese society, and one can be truly accepted as a mature, virtuous person in Japanese society only when one lives up to both ‘giri’ and ‘ninjou’. –Sachiko Horiguchi]

চলুন আমরাও স্বার্থপরতার দেওয়াল ভেঙ্গে মানুষকে ভালোবাসোতে শিখি…

আর ১১ টা বাকি থাকলো… 😊😊

৬। ওন (おん) [নৈতিক ঋণ] {moral indebtedness, gratitude toward the people who gave you favors}

এর আগে ‘গিরি’ মানে বলেছি যে, ‘The path of righteousness for things’ ও ‘Reciprocation of gratitude from others’। এবার বলবো “ওন (おん) [নৈতিক ঋণ] {moral indebtedness}”-এর কথা!

আচ্ছা, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কেনো?!

আরেকটু সহজ উদাহরণ দিই! জাপানে পড়াকালীণ সময়ে আমার ‘বেটার-হাফ’ [বর্তমানে বাংলাদেশের পক্ষের সবচেয়ে বড়ো ‘উকিল’!] আমাকে খুব ফুসলাতো এই বলে যে, “চলো আমরা জাপানে থেকে যাই! এখানকার স্বাস্থ্য-সেবা ব্যবস্থা কত্ত ভালো, স্কুল-কলেজ কত্ত ভালো, সমাজ কত্ত নিরাপদ! আয় রোজগারও ভালো! চলো আমরা এখানেই থেকে যাই!” কিন্তু, আমি রাজী হইনি! তাকে উত্তর দিতাম এই বলে যে, “বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়াদের মধ্যে আমরা দু’জনই যেনো শেষ ব্যক্তি হই” [মানে, সব্বাই চলে যাওয়ার পরেও নিতান্ত বাধ্য না-হলে দেশ ছাড়ার প্রশ্নই আসে না!]। মনের মধ্যে কি জানি কেমন কেমন করে!!! যে দেশে জন্মালাম, যে দেশের আলো-বাতাসে বড় হলাম, যে দেশের খেয়ে-পরে মোটা-তাজা হলাম; সুযোগ পেয়ে স্বার্থপরের মতো সে-ই দেশ ছেড়ে চলে যাবো!? এও কি কখনও সম্ভব!? [যাঁরা উপযুক্ত সুযোগ না-পেয়ে দেশে ফিরতে পারেন না, তাঁদের কথা ভিন্ন! আবার, যাঁরা উপযুক্ত জায়গা (কর্মসংস্থান) না-পেয়ে প্রবাসী হন, তাঁদের কথাও ভিন্ন!] যে অনুভূতির জন্য আমি দেশ ছাড়তে পারিনি (মন সায়ই দেয়নি) সেই অনুভূতির নাম “ওন (おん) [নৈতিক ঋণ] {moral indebtedness}”। আরও বৃহৎ ও গভীর অর্থে, যে অনুভূতির জন্য মাতৃভূমি স্বাধীন করতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিতে কুণ্ঠিত হননি, সে-ই অনুভূতির নাম ‘ওন’!

‘ওন (おん)’ এর সবচেয়ে সহজ শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ‘gratitude toward the people who gave you favors’ যার সাথে ‘Reciprocation of gratitude from others – গিরি’-র মিল আছে। কিন্তু এর তাৎপর্য আরও গভীরের, যেখানে এটা ‘moral indebtedness’ বোঝায়। এই অনুভূতি হচ্ছে সে-ই অনুভূতি যার কারণে জীবন চলে গেলেও মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করে না! দেশের জন্য মানুষ জীবন দিয়ে দেয়। There is neither rationality nor selfish interest involved in the feeling!

আমাদের দেশের মানুষের মধ্যেও ‘ওন (おん)’  আছে! কিন্তু গুণে দেখতে হবে কতজনের মধ্যে তা আছে?! যারা ‘বাংলাদেশে আয় করে আর পাশের দেশে বাজার করে’; ‘ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে টাকা ‘কালো’ করে, আর কালো টাকা সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে’; ‘ঘুষ দুর্নীতি লেজুড়বৃত্তি করে পকেট ভারী করে’- এদের কি ‘ওন (おん)’  আছে?!

একটা ছোট্ট গল্প বলি! আমার এক জাপানিজ বন্ধুকে দেখেছিলাম যে, সে Amazon (online) থেকে কিচ্ছু কেনে না! তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এমন কেনো করো? সে উত্তরে বলেছিলো- ‘Amazon একটা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে নিবন্ধন নেয়নি। তাই আমি Rakuten থেকে শপিং করি, Amazon থেকে না!’! আচ্ছা, এই অনুভূতিকে কি ‘moral indebtedness’ বলা যায়?!

শেয়ার করুন: