April 27, 2024
ফিচারলাইফস্টাইলসাক্ষাৎকার ও মতামত

করোনা : প্রাথমিক ধারণাগুলি

আলি আবরার

একবার ভাবুন তো, চারিদিকে শুধু কোলাহল রিকশা-গাড়ির শব্দে ব্যস্ত জীবন এগিয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোতে। হয়তো বসে আছেন পাড়ার টঙ্গের দোকানে এক কাপ গরম চা হাতে বা প্রিয় মানুষটার সাথে কোন রেস্তেরায়। কেমন হতো জীবনটা যদি আজ বদ্ধ ঘরে না থেকে খুব সাধারণ একটি দিন পার করতেন জীবনের আগের ফেলে আসা দিনগুলার মত ?

একেক জনের উত্তর একেক রকম হলেও আজকের পরিস্থিতি সবারই এক ! আজ বিশ্বের দিয়ে তাকিয়ে দেখলে দেখতে পাবেন শুধু আমরা নয়, বিশ্ববাসী সবাই আজ একই পরিস্থিতির শিকার সেটা হচ্ছে “করোনা ভাইরাস”। এবং সময়ের প্রয়োজনে আজ আমরা ঘরে বন্ধি। আসলে বন্ধি বলাটা এখানে মানাচ্ছে না কারণ এইটা এক ধরনের যুদ্ধ আর এই যুদ্ধের ধরন আলাদা । যুদ্ধ মানেই বন্দুক-পিস্তল গুলি-বোমাবর্ষণ না। কিছু যুদ্ধ আছে মনের ভেতরের, কিছু আছে আঞ্চলিক ও কিছু অদৃশ্য শত্রুর সাথে সংঘটিত। করোনাটাও ঠিক একটি অদৃশ্য শত্রু যার নেই কোন আকার, নেই কোন রঙ, নেই কোন বর্ণ। তাঁর লক্ষ্য একটাই সেটা হল “মৃত্যু”। আর এই যুদ্ধে জিততে হলে প্রয়োজন ঘরে থাকা ও সচেতনতা তৈরি করা যেটা এখন শুধুমাত্র সময়ের প্রয়োজন। কেন সময়ের প্রয়োজন তা কিন্তু বলা হয়নি এখনো। এই সময়টা প্রয়োজন বিজ্ঞানী ও গবেষকদের জন্য যারা এর প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করছে, আর এই সময়তা আমরা তাদের দিতে বাধ্য। কারণ এই রোগটা একদম নতুন !

 

করোনা আসলে কি ?

করোনা বলা বলেও এই ভাইরাসটার নাম “কোভিড-৯”। করোনা ভাইরাস হচ্ছে এমন কিছু ভাইরাসের একটি শ্রেণী যা মানুষের শ্বাসতন্ত্রকে আক্রমন করে সংক্রামিত করে। ইবোলা, সার্স, মার্স ভাইরাসগুলি এই শ্রেণির আওতায়। এই ভাইরাসগুলার সবারই প্রায় সব বৈশিষ্ট্য একই রকম শুধু সংক্রামণ করার পদ্ধতি আলাদা। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এরা “এনভেলপড ভাইরাস” ও এদের আক্রান্ত করার ক্ষমতা থাকে রিবোনিউক্লিয়িক এসিড(আরএনএ) তে। মানে হল ভাইরাসটি একটি আবরণে আবদ্ধ থাকে যার ভেতর থাকে ঐ আরএনএ গুলা। এর জন্য খুব সহজেই এইভাইরাসটি নষ্ট হয়না। এই আরএনএ কি জিনিস তা আরেক ইতিহাস। আমি নিজে ডাক্তার কবিরাজ না হলেও শুধু এটুকু বলতে পারব এই আরএনএ ই সকল কিছুর মূল !

 

এই আবরণের বাইরে থাকে কিছু স্পাইক যা আপনার শরীরের বিশেষ কিছু জায়গায় আটকিয়ে আরএনএ গুলা ঐ বিশেষ জায়গার কোষে প্রবেশ করিয়ে দেয় যা আস্তে আস্তে আপনার ভাইরাস বৃদ্ধি করে পুরা শরীরে ছরিয়ে যায়। এই বিশেষ যায়গাগুলা হল গলার অভ্যন্তরে, পাকস্থলীতে ইত্যাদি যা বাহ্যিক না। এটুকুও বলে রাখি এর সাইজ ০.১৪ থেকে ০.০৬ মাইক্রোনের ভেতরে।

 

এর উৎপত্তি চায়নার উহানে হলেও বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত জানেনা এটা এলো কিভাবে। কিন্তু প্রাথমিক কিছু গবেষণায় এটা প্রতীয়মান যে এটি একটি Zoonotic ভাইরাস যার মানে এটি বন্যপ্রাণী থেকে মানব শরীরে ছড়ায় ও আস্তে আস্তে একজন থেকে আরেকজনে। প্রাথমিক ভাবে গবেষণায় এটিও দেখা গেছে বাদুরে এই ভাইরাসটা থাকে যা করোনা শ্রেণির অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে যুক্তরাষ্ট্র সহ অনেক দেশেরই দাবি এটি উহানের কোন ল্যাব থেকে ছড়ানো হয়েছে যা একটি বায়োলজিক্যাল অস্ত্র হিসেবে তারা প্রস্তুত করছিল তবে এগুলার কোন প্রমান এখনো পর্যন্ত নাই এবং চীনও এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে এর তীব্র নিন্দা করে বলেছে এইটি আমেরিকা ছড়িয়েছে তাদের দেশে এসে। এই কাদা ছোড়াছুড়ি অস্বাভাবিক কিছুনা, আগে পরে বিশ্ব রাজনীতিতে এটা হয়েছে তবে এই সুযোগ নিয়ে অনেকেই অনেক গুজব ছড়াচ্ছে দেখতে পেলাম।

কিভাবে আপনাকে আক্রান্ত করে ?

এই ভাইরাসের পাখা নাই বা বাতাসে উড়েবেড়ায় না। কোন আক্রান্ত ব্যাক্তির হাচিঁ-কাশি থেকে মূলত এই ভাইরসটি ছড়ায় বা ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়। ধরুন কোন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি দিলো, আপনি যদি তাঁর ৩ ফুটের ভেতরে থাকেন তবে আক্রান্ত হতে পারেন। এই হাঁচি-কাশির ড্রপলেট যদি কোথাও পরে আর আপনি যদি সেখানে হাত দেন ও সেই হাত না ধুয়ে যদি চোখে, মুখে বা নাকে দেন তবে আপনার আক্রান্ত হওয়ার প্রবল সম্ভবনা আছে।  এই ভাইরাসটি  মূলত নাক-চোখ-মুখ থেকেই আপনার শরীরে প্রবেশ করে। তাঁরপর প্রথমে আপনার গলায় সংক্রামণ শুরু করে ও পরে শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে যায়।

 

ভ্যাকসিন বা ওষুধ আছে কি ?

না, এখনো পর্যন্ত নাই। তবে পৃথিবীর সকল উন্নত দেশই প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এর ভ্যাকসিন বা ওষুধ বের করতে। প্রাথমিকভাবে কয়েকটি দেশে অন্যান্য রোগের বিশেষ কিছু ওষুধ এর জন্যে একটু কার্যকারিতা দেখালেও পুরাপুরি ভাবে এইটাকে সফলতা তারা বলছেনা। বরং আরো গবেষণার জন্য সময় চেয়েছে।

এর লক্ষন গুলা কি কি ?

করোনায় প্রধান লক্ষন গুলা হল-

  • জ্বর
  • গলা ব্যাথা
  • শুকনা কাশি
  • মাঝে মাঝে ডাইরিয়া

কিন্তু অবস্থা একটু খারাপের দিকে গেলে বুকে ব্যাথা,শ্বাসকষ্ট  শরীরে দুর্বলতা অনুভব করা, নিউমোনিয়া ও অরগ্যান ফেইলর ও হতে পারে।

 

আমাদের তাহলে কি করনীয় এখন ?

প্রথমত ঘরে থাকুন। ঐ যে প্রথমে বললাম না, সময়ের প্রয়োজনে আমাদের ঘরে থাকবে হবে, এই সময়টাতে গবেষণা করে করোনার ভ্যাকসিন বা ওষুধ তৈরি করা হবে।

দ্বিতীয়ত বেশি বেশি করে হাত পরিষ্কার রাখতে হবে সাবান দিয়ে ধুয়ে। সাবানে ক্ষার যত বেশি তত ভাল। একমাত্র সাবান পানিই ১০০% ভাবে এই ভাইরাসটি ধ্বংস করতে পারে।

এছাড়াও ৭০% অ্যালকোহল মিশ্রিত দ্রবন বা স্যানিটাইজারও এর জীবাণু মারতে সক্ষম।

তৃতীয়ত যদি বাসা থেকে বের হতেই হয় খুব জরুরী কাজে তাহলে অবশই

  • মাস্ক পরবেন ( সার্জিকাল ) ও সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা ফেরা করবেন।
  • পারলে ফুল হাতা জামা পরবেন বাইরে যাওয়ার আগে।
  • বাইরে থাকা অবস্থায় চোখে মুখে নাকে হাত দিবেন না।
  • টাকা ধরার পর হাত সাবান-পানি আর না থাকলে স্যানিটাইজার বা অ্যালকোহল মিশ্রণ দিয়ে মুছে ফেলবেন।
  • বাইরে থেকে বাসায় এসে আগেই জামা কাপর খুলে তা ধুয়ে দিবেন ও গোসল করে নিবেন। সাথে যে জুতা পরে গিয়েছিলেন তাঁর নিছে ব্লিচিং দিয়ে ধুয়ে দিবেন।
  • বাজার করে আনলে তা কলের পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিবেন। এর পর সংরক্ষণ করবেন।
  • কারো যদি সর্দি কাশি থাকে তাঁর থেকে কমপক্ষে ৩ ফিট দূরে থাকবেন ও দূরত্ব বজায় রাখবেন।
  • আশে পাশে কেউ আক্রান্ত হলে স্বাস্থ্য সেবায় কল দিবেন।
  • বার বার ধরা হয় এমন বস্তু হাইডোজেন পারঅক্সসাইড বা ব্লিচিং দ্রবন ( ১ঃ১০ ব্লিচিং : পানি ) দিয়ে দিনে একবার ধুবেন।
  •  প্রয়োজন ছাড়া একদমই বাইরে বের হবে না।
  • ঘরে প্রয়োজনীয় খাবার(১৫দিনের) ও ওষুধ মজুদ রাখবেন।
  • স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও নির্দিষ্ট পরিমান ভিটামিন নিন ফলের মাধ্যমে।
  • ব্যায়াম করবেন নিয়মিত।
  • মানসিকভাবে বলীয়ান থাকুন।

 

এই কভিড-১৯ নিয়ে এখনো গবেষণা শেষ হয়নি। আসলে গবেষণা যে কতদুর তা বিজ্ঞানীরাও ঠিক মত হয়তো জানেন না। কারণ প্রত্যেকদিনই আন্তর্জাতিক মিডিয়া ঘাটলে দেখা যায় নতুন নতুন কিছু জানছে ও নতুন তথ্য, উপাত্ত প্রকাশ করছে। কিছু লক্ষন আবার কিছু এর আক্রান্তের ধরনের সাথে সম্পর্কিত। তবে সবারই এক ধারণা এর ভ্যাকসিন বের হতে অন্তত বছর খানিক লাগবে।

 

একটা জিনিস মোটামুটি নিশ্চিত এই কোভিড-১৯ শেষ হয়ে গেলে পৃথিবী আর আগের মত থাকবেনা। অনেক কিছুই নতুন করে শুরু হবে। সেদিন দিনটির জন্য সুস্থ থাকুন আপনারা।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *