May 5, 2024
জাতীয়

একটি ব্যাগ হাতছাড়া করতেন না খুনি মাজেদ

কলকাতার রিপন স্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের একটি বাড়িতে দীর্ঘ ১৯ বছর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি আব্দুল মাজেদ। অবাঙালি মুসলিম অধ্যুষিত এ এলাকায় মাজেদের পরিচিতি ছিল আলি আহমেদ নামে। ইংরেজির শিক্ষক। বেডর্ফোড লেনের ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখাতেন।

৭ এপ্রিল ঢাকার মিরপুর থেকে গ্রেফতারের পর পরদিন কলকাতার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর দেখে বেডফোর্ড লেনের বাসিন্দারা চমকে ওঠেন। বুঝতে পারেন ৭২ বছরের ইংরেজি শিক্ষক আসলে বঙ্গবন্ধুর খুনি আব্দুল মাজেদ। তাতে যে এলাকাবাসীর কোনো মাথাব্যথা নেই তা বোঝা গেলো যখন মাজেদের বাসা লাগোয়া দোকানিও বলে দিলেন ‘জানি না, খুঁজে নিন’। এমনকি ছবি দেখালেও অনেকেই চিনতে অস্বীকার করেন।

‘এখানে ১৯ বছর ধরে ছিলেন মাজেদ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। এলাকার ইংরেজির মাস্টারমশাই। কোনোদিন মহল্লায় ঝগড়া-আশান্তি করেননি। ধর্মীয় চাঁদা বা সামাজিক কারণে চাঁদা কোনো কিছুতেই কার্পণ্য করেননি। তো আমরা তাকে খারাপ বলি কী করে।’
এমন বক্তব্য এলাকাবাসীর। আর এলাকায় ঢুকতেই কয়েকশ লোক ঘিরে ধরার মধ্যেও ছিল রহস্য। পরে পুলিশের সহায়তায় সে সমস্যার সমাধান হয়।

পার্কস্ট্রিট পুলিশ সূত্র জানায়, ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় চিকিৎসার জন্য বাসা থেকে বের হন মাজেদ। এরপর আর ফিরে আসেননি। কোনোদিনই এরকম করেননি। স্বভাবতই উদ্বিগ্ন হয়ে স্ত্রী ২৩ ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিট থানায় মিসিং ডায়েরি করেন। তদন্ত শুরু করে পার্ক স্ট্রিট থানা। পুলিশ মাজেদের ভাড়া বাড়ি থেকে একটি ব্যাগ পায়। সেই ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে কয়েকটি সিম কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার আইডি, ভারতীয় পাসপোর্ট ও ঢাকার একটি পরিবারের ছবি পায়।  ওই ব্যাগ নাকি কাছ ছাড়া করতেন না মাজেদ। টাকা-পয়সা সব ওই ব্যাগেই থাকতো। এমটাই মত এলাকার লোকেদের।
খুব একটা বাসা থেকে বের হতেন না মাজেদ। এলাকার নির্দিষ্ট একটি চায়ের দোকান থেকেই চা খেতেন। এর বাইরে আর কোনো চায়ের দোকান থেকে চা খেতে দেখেনি কেউই। কাঁচাবাজার করতেন এলাকার ভেতরেই। সরকারি রেশন দোকান থেকে নিতেন চাল, ডাল, তেল, নুন ইত্যাদি। প্রাইভেটে কোনোদিন নিজের ও পরিবারের চিকিৎসাও করাননি। যা করাতেন কলকাতার সরকারি হাসপাতাল থেকে।

এলাকাবাসী জানান, স্পষ্ট ইংলিশ ও হিন্দি বলতে পারতেন। বরঞ্চ বাংলাটাই ভালোভাবে বলতে পারতেন না। তবে মাজেদের হাতে খুব বেশি শিক্ষার্থী ছিল না এবং তা থেকে যা পারিশ্রমিক আসতো তা দিয়ে পরিবার চালানোটাই কঠিন। তাহলে চলত কী করে? আলি আহমেদ ওরফে আব্দুল মাজেদের ছিল আরও একটি ব্যবসা। অনেকের মতে তা ছিল সুদের ব্যবসা। আবার অনেকের মতে দুই দেশের মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করতেন মাজেদ।

মাজেদের ঘনিষ্ঠ বলতে এলাকার ভেতরে এক ওষুধ দোকানের মালিক। তার সঙ্গেই সময় কাটাতেন। এলাকাবাসীর কয়েকজনের মত, অনেক কিছুই জানতে পারেন ওই ওষুধ দোকানের মালিক। কিন্তু তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন মাজেদের খবর জানাজানির পরপরই।

যে বাড়িতে মাজেদ থাকতেন সে বাড়ির মালিকের নাম শফিক। বাড়িটি চারতলা। প্রতি তলায় চারটি করে রুম। বাইরে কোনো প্লাস্টার নেই, ইট খসে পড়ছে। ভিতরের অবস্থাও একই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখা যায় মাজেদ যেখানে থাকতেন সে রুমে তালা ঝোলানো। দরজা আবার কলাপসিবল গেট। ভিতরে পর্দা।

শফিক জানান, তার বাড়ির দোতলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন আব্দুল মাজেদ। পরিবার বলতে মাজেদের থেকে ৩২ বছরের ছোট স্ত্রী সেলিনা বেগম ও তাদের ছয় বছরের মেয়ে। বিয়ের আগে তালতলার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন মাজেদ। বিয়ের পর তার বাসায় ওঠেন। পরিবারের কেউই সেভাবে পাড়ায় মেলামেশা করতেন না। খুব কম সময়ের জন্য বেরোতেন মাজেদ। বাসার গেটে সব সময় থাকতো তালা। বাইরের কেউেই কোনোদিন বাসার ভেতরে যায়নি।
এমনকি মাজেদের পাশের রুমের ভাড়াটে দৌলত আলমের কথায়, কোনোদিন সেভাবে কথা বলতে দেখিনি। যাতায়াতের পথে সেলাম ছাড়া কিছুই কথা হতো না। ঈদের সেমাই কোনোদিন দেওয়া-নেওয়া হয়নি। আমরা ভাবতাম, মহল্লার মুরুব্বি আদমি আছে তাই বেশি ঘাটাতাম না। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় কারণে চাঁদা চাইলে কোনোদিন নাও করেননি।

শফিক জানান, তার জানা মতে বাসার ভিতরে সেরকম কোনো আসবাবপত্র ছিল না। মাজেদের বসবাস কালে শফিকও নিজেও কোনোদিন রুমের ভেতরে ঢুকতে পারেননি। তবে প্রতি মাসের ভাড়া ঠিকঠাক দিয়ে দিতেন। মাজেদের শ্বশুরবাড়ি হাওড়ার উলুবেড়িয়ায়। আব্দুল মাজেদ চলে যাওয়ার পর, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে যায় এবং রুমে তারাই তালা দিয়ে যায়।
কলকাতার প্রশাসনিক সূত্র জানায়, পরিচয় গোপন করে মাজেদ লিবিয়া থেকে প্রথমে এলিয়ট রোড সংলগ্ন তালতলায় ছিলেন ৪ বছর। পরে ভিন্ন মতলবে বিয়ে করেন উলুবেড়িয়ার এক মেয়েকে। একে একে নাগরিকত্বসহ নিজের নামে রেশন, ভোটার আইডি কার্ড, পাসপোর্ট সবই বানান। তার মোবাইলে বঙ্গবন্ধুর পলাতক অন্য খুনিদের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য রয়েছে। ভারতের বহুল আলোচিত এনআরসি ইস্যুতেও এলাকার নেতৃত্ব দেন মাজেদ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *