ওয়েস্টিনের মালিক-কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতাও দেখা হবে: র্যাব
গুলশানের ঢাকা ওয়েস্টিন হোটেলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইটটি ভাড়া নিয়ে নিচের সারির একজন রাজনৈতিক কর্মী মাসের পর মাস কী করে আসছিলেন, তা ওই পাঁচ তারা হোটেলের মালিক ও পরিচালনা কর্তৃপক্ষের শীর্ষ ব্যক্তিরা ভালোভাবেই জানতেন বলে র্যাব কর্মকর্তাদের ধারণা।
ওয়েস্টিনের ২২ তলায় চার বেডরুমের ওই স্যুইটের প্রতিরাতের ভাড়া সাধারণভাবে দুই হাজার ডলারের মত। ওই স্যুইট ভাড়া নিয়েছিলেন যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া, যিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন।
২৮ বছর বয়সী ওই নারী সমাজের উঁচুতলার লোকদের জন্য ‘যৌনসেবার কারবার’ চালাতেন বলে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার কথা বলছেন র্যাব কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, অনেক হোমড়া চোমড়া রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীর সঙ্গে পাপিয়ার যোগাযোগ ছিল, তাদের মধ্যে হোটেলের মালিকানা ও পরিচালনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও আছেন।
পাপিয়ার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোনে বহু ভিডিও পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা, যেগুলো এখন পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাপিয়া হোটেলের ভেতরে তার কক্ষে এসব অপকর্ম করেছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ তার অবৈধ কার্যক্রমকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে কি না বা তার কার্যক্রমকে বেগবান করতে অন্য কোনোভাবে সহযোগিতা করেছে কি না তা তদন্ত করে দেখা হবে।
“যদি তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।”
ওই হোটেলের ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাবদ পাপিয়া প্রতি মাসে পরিশোধ করেছেন দেড় কোটি টাকার মত, আর তার পুরোটাই তিনি নগদে দিয়েছেন বলে র্যাব কর্মকর্তাদের ভাষ্য। তবে হোটেল কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি নন।
রিমান্ডে পাওয়ার পর সোমবার বিকালে ঢাকা হাকিম আদালত থেকে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে নিয়ে যায় পুলিশ।
র্যাবের এক অভিযানে গত শনিবার ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হন নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পাপিয়া ওরফে পিউ, তার স্বামী নরসিংদীর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন এবং তাদের সহযোগী আরও দুজন। তাদের কাছে পাওয়া যায় বিদেশি মুদ্রা ও জাল নোট।র্যাব-১ এর অধিনায়ক শাফী উল্লাহ বুলবুল সেদিন বলেন, পাপিয়া গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের ‘প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট’ ভাড়া নিয়ে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ চালিয়ে আসছিলেন।
পাপিয়াদের জিজ্ঞাসাবাদের পর হোটেল ওয়েস্টিনে পাপিয়ার নামে বুক করা সেই স্যুইট এবং ইন্দিরা রোডে তাদের দুটি অ্যাপার্টমেন্টেও অভিযান চালায় র্যাব।
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, হোটেল কর্তৃপক্ষকে অন্ধকারে রেখে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসা কারও পক্ষেই সম্ভব না। তাছাড়া অনেকের সঙ্গে পাপিয়ার ছবি ও ভিডিও এখন সোশাল মিডিয়ায় আসছে। এমন এক ভিডিওতে ওয়েস্টিন ঢাকার মূল মালিক নূর আলীকেও পাপিয়াসহ বেশ কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে গল্প করতে দেখা গেছে।
ওয়েস্টিনের বোর্ডে কারা ‘দি ওয়েস্টিন ঢাকা’ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ভ্রমণ ও পর্যটন খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের একটি হোটেল। গুলশান ২ নম্বরে ওয়েস্টিনের ওই ২৪ তলা হোটেল ভবনের কাজ শেষ হয় ২০০৬ সালে। আর ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট ২০১২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এ কোম্পানির উদ্যেক্তা পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন ব্যবসায়ী নূর আলী, যিনি ইউনিক গ্রুপেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আর তার স্ত্রী সেলিনা আলী ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান। এক সময় ছাত্র ইউনিয়ন করা নূর আলী ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ঢাকা-২ আসন থেকে সংসদ নির্বাচন করে পরাজিত হন। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ১৩ জুন তেজগাঁও থানায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী (আজকের প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা একটি চাঁদাবাজি মামলার বাদী ছিলেন এই নূর আলী। পরে অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে পুলিশ ওই মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নূর আলীর উপস্থিতিতেই এক নির্বাচনী সভায় শেখ হাসিনা বলেন,যারা মিথ্যা মামলা দিয়েছিল, তারাও ভুল বুঝে ক্ষমা চেয়েছে। নূর আলীর আরেক কোম্পানি বোরাক রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষ থেকে মনোনীত পরিচালক হিসেবে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের পর্ষদে আছেন পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিস শারাফাত এবং নূর ট্রেড হাউজের প্রতিষ্ঠাতা সিইও খালিদ নূর। ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেডের মনোনীত পরিচালক হিসেবে আছেন ইউনিক গ্রুপের পরিচালক গাজী মো. সাখাওয়াত হোসেন এবং চার্টার্ড লাইফ ইনসুরেন্স কোম্পানির পরিচালক গোলাম সারওয়ার, যিনি নূর আলীর বিভিন্ন কোম্পানির অর্থ ব্যবস্থাপনায় দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দৈনিক আমাদের সময়ের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক পদে আছেন। এছাড়া সাবেক ব্যাংকার কে মাহমুদ সাত্তার (মিঠু সাত্তার) এবং মোহম্মদ ফোরকান উদ্দিন এবং অ্যাকাউন্টিং ফার্ম এম এম রহমান অ্যান্ড কোং এর অংশীদার মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দিন ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের পর্ষদে আছেন স্বাধীন পরিচালক হিসেবে। |
কী করেছেন পাপিয়া?র্যাব কর্মকর্তাদের ধারণা, মাদক-অস্ত্র চোরাচালান, জমি দখল করিয়ে দেওয়ার মত কাজের পাশাপাশি ওয়েস্টিন হোটেলে নারীদের দিয়ে ‘যৌন বাণিজ্য’ চালিয়ে আসছিলেন শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ এবং সেখান থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আসত ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের এই নেত্রীর হাতে।
র্যাব-১ এর উপঅধিনায়ক সাফাত জামিল ফাহিম জানান, গত বছরের ১২ অক্টোবর হোটেল ওয়েস্টিনের প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইট ভাড়া নেন পাপিয়া। গ্রেপ্তারের সময়ও তার নামেই ছিল ওই স্যুইট, তবে মাঝে বেশ কিছুদিন ছিলেন না।
আরও দুটো কক্ষ ভাড়া নেওয়া ছিল পাপিয়ার নামে। ১২ অক্টোবরের পর থেকে মোট ৫১ দিন ওই স্যুইটে থাকার জন্য পাপিয়া ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৭ টাকা বিল মিটিয়েছেন। হোটেলের বার ব্যবহারের জন্য ব্যয় করেছেন এক কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিদিন হোটেল বেয়ারাদের টিপস দিতেন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা।
র্যাব কর্মকর্তা ফাহিম বলছেন, পাপিয়া সব সময় বিল মেটাতেন নগদ টাকায়, চেক কিংবা ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতেন না।
কীভাবে পারলেন পাপিয়া?পাপিয়ার বিরুদ্ধে করা তিনটি মামলায় ওয়েস্টিন হোটেলে পাপিয়ার কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেওয়া হলেও তাতে হোটেল কর্তৃপক্ষের কোনো যোগাযোগ ছিল কি না- সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
তবে হোটেল কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে এ ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন তুলে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু।
তিনি লিখেছেন, “আন্তর্জাতিক চেইন ব্যবস্থাপনার ৫-তারা হোটেলে রুম বুকিং দিতে… বিস্তারিত পরিচয় লিপিবদ্ধ করতে হয়। এজেন্সি প্রয়োজনে এসব তথ্য সংগ্রহও করে থাকে। বাইরের সাক্ষাৎকারী সাধারণত লবিতে বসে কথা বলেন, কদাচ রুমে যান। সেখানে ভাড়াটে নারী এনে অনৈতিক কাজ চললো কি হোটেল কর্তৃপক্ষের অজান্তে? পাপিয়ার মামলায় হোটেল কর্তৃপক্ষ কি জবাবদিহিতায় আসবে?”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. শাকের আহমেদও বলছেন, ওয়েস্টিন হোটেল নিয়মের অজুহাত তুলে দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “হোটেলের দায়বদ্ধতা হল, তাদের কাছে (হোটেলের অতিথি) কে আসবে না আসবে সেগুলো স্ট্রিক্টলি মনিটর করবে। বোর্ডার ছাড়া তো রাতে হোটেলে আর কারও থাকার কথা না। … এ ব্যাপারে হোটেল মালিকরা দায় এড়াতে পারে না। বাইরের মানুষ এসেছে, বাইরের মানুষ থেকেছে উইদাউট দেয়ার কনফার্মেশন, এটা অসম্ভব ব্যাপার।”
এসব প্রশ্নের উত্তরে ওয়েস্টিনের মার্কেটিং কমিউনিকেশন বিভাগের সহকারী পরিচালক সাদমান সালাহউদ্দিন বলেন, “এ ধরনের ঘটনা যে কোনো জায়গায় হতে পারে। কিন্তু এ ঘটনায় হোটেল দায়ী হতে পারে না। আমাদের গেস্ট এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে। রুমে যারা আছে, তাদের প্রাইভেসি আছে। এখন কে কোথায় কী করেছে, সেটা দেখার সুযোগ নেই। আমাদের রুমের মধ্যে কোনো ক্যামেরা নেই। ভেতরে কী হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি না।”
পুলিশ এ বিষয়ে কী করছে জানতে চাইলে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে এখনও আসেনি। অভিযোগ থাকলে আমরা দেখব। এখন বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মামলার তদন্ত করছে। হোটেলের কেউ দোষী হলে তা তদন্তেই বেরিয়ে আসবে।”