April 24, 2024
সম্পাদকীয়

পরোপকারী সাংবাদিক বন্ধু সুবীরদা’র কিছু স্বপ্ন ছিল …

এস এম জাহিদ হোসেন

দিন-মাসের কথা মনে নেই। সালটা মনে আছে ১৯৯৯। রফিক ভাই খুব অসুস্থ হলে বালু ভাই আমাকে সাদা-কালো দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকার বাইরের পাতা দেখার দায়িত্ব দিলেন। জন্মভূমি পত্রিকায় কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বাদ পড়ছে কিনা তা’ নিয়ে দৈনিক পূর্বাঞ্চল-এর বার্তা সম্পাদক অরুণদা ও চীফ রিপোর্টার অমিয়দা’র সাথে রাতের বেলা টেলিফোনে প্রায়-ই কথা হতো।

কোন একদিন দুপুর বেলা। পিকচার প্যালেসের মোড়ে অরুণদা আম কিনছেন। আমি এগিয়ে যেতেই দোকানিকে দেখিয়ে বললেন-জাহিদ এঁকে চেনো। বললাম ৮৭-৮৮’র দিকে সরকারি আযমখান কমার্স কলেজে দেখেছি। আমি ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়তাম। আর উনি হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে আমার উপরে পড়তেন। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মিছিলে-মিটিং-এ তাঁকে দেখেছি। সেবছর কলেজ সংসদে ছাত্রলীগের শহীদুল হক মিন্টু-জিয়াউল ইসলাম জিয়া পরিষদে শ্রেণী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

অরুণদা বলতে থাকেন সুবীর বাবু’র সাংবাদিকতায় ভীষণ আগ্রহ। তুমি জন্মভূমিতে তাঁকে নিতে পারো। আমি বললাম আপনি লিয়াকত ভাইকে বলে পূর্বাঞ্চলে তো নিতে পারেন। অরুণদা বললেন সুবীর বাবুকে সাংবাদিকতায় পাকা হতে হবে। তা’ না হলে সাহেব নিতে চাইবে না। তুমি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে সুবীর সাংবাদিকতায় ভাল করবে।

আমার বাড়িতে আসতেন সুবীরদা। প্রেস রিলিজ করানো থেকে ছোট ধরণের সংবাদ লেখা শিখাতাম। সমস্যা, উন্নয়ন, অপরাধমূলক সংবাদ লেখাসহ বিভিন্ন ধরনের সংবাদ তৈরীতে ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি।

ইতোমধ্যে বালু ভাইকে অনুরোধ করে ২/৩ জনকে বার্তা বিভাগে নিয়েছি। আবার সুবীরদাকে নিতে অনুরোধ করলাম। বালু ভাই পত্রিকার অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কথা তুলে ধরেন। পরে বালু ভাইকে রাজী করাতে পারলাম। তবে কম বেতনে। সুবীরদা অল্প দিনেই অফিসের সকলকে আপন করে নিলেন। সাংবাদিক এস এম হাবিব, রকিব উদ্দীন পান্নু, মামুন রেজা, সৈয়দ শামছুল হুদা পুতুল, কাজী শামীম আহমেদ, মোজাম্মেল হক হাওলাদার, সুবীর রায়, গাজী মনিরুজ্জামান, নুরুল হাসান লিটু ও দেবব্রত রায়সহ আরো অনেককে নিয়ে দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকা শক্তিশালি জনবল কাঠামো নিয়ে প্রকাশিত হতো। টীম জন্মভূমিকে আরো ভালো করতে আমাদের সবসময় উৎসাহ ও সাহস যোগাতেন বালু ভাই।

সুবীরদা ধীরে ধীরে একজন দক্ষ রিপোর্টার হয়ে ওঠনে।বালু ভাই’র মৃত্যুর কয়কেমাস পরে সুবীরদা দৈনিক পূর্বাঞ্চল-এ যোগ দয়ে। ২০০২ সালে এ পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার হারুন-উর রশীদরে নৃশংস হত্যাকান্ডরে পর পাঠক হিসেবে দেখেছি অপরাধমূলক রিপোর্ট এ কিছু দুর্বলতা।ক্রাইম রিপোর্টারের  সেই শূন্যস্থানটি ধীরে ধীরে পূরণ করে নয়ে সুবীরদা।

অত্যন্ত বন্ধুবৎসল সুবীরদা খুব সহজইে সবাইকে আপন করে নিতে পারতনে।স্বাধীনতা ও মুক্তযিুদ্ধরে পক্ষরে একজন বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর ছিলেন তিনি।মুক্তযিুদ্ধরে চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে তিনি খুলনা সাংবাদকি ইউনয়িন ও খুলনা প্রেস ক্লাবের নেতৃত্ব দিয়েছেন।গতবছর খুলনা সিটি  কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সাংবাদিক  সম্পাদকেরা ‘সচেতন সাংবাদিক সমাজ’ গঠন করেন।খুলনার উন্নয়নরে র্স্বাথে ‘সচেতন সাংবাদকি সমাজ’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রার্থী হিসাবে তালুকদার আব্দুল খালেককে মেয়র পদে সর্মথন করে। একজন দক্ষ নেতা ও সংগঠক হিসেবে এসময় সুবীরদাকে আমরা সবসময় পাশে পেয়েছি।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে র্বতমান সরকাররে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে মুক্তযিুদ্ধরে চতেনায় উদ্ভাসতি সাংবাদিকদের নিয়ে ’স্বাধীনতা সাংবাদিক পরিষদ’ গঠন করা হয়।সুবীরদাকে সংগঠনরে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করা হয়।তাঁকে এসময় সাংবাদিক -সম্পাদকদের আরকেটি সংগঠন ‘খুলনা উন্নয়ন মঞ্চ’রও কোষাধ্যক্ষ করা হয়।

ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে প্রশাসন বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনরে সাথে সু-সর্র্ম্পক গড়ে ওঠে তাঁর।সহকর্মী সহ পরিচিতি অনেককে বিপদে আপদে তাঁকে অনকে পরোপকার করতে দেখেছে সিনিয়র জুনিয়র সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংবাদ দিয়েও তিনি সহযোগিতা করতেন।

প্রায় ১৪ বছর দৈনিক পূর্বাঞ্চল-এর সাথে যুক্ত থাকা ছাড়াও তিনি বিডিনিউজ ২৪.কম, রেডিও টুডে’র খুলনা সংবাদদাতা ছিলেন। কিছুকাল তিনি একটি এনজিওতে চাকুরী করেছেন। মহেশ্বরপাশার একটি বেসরকারী কলেজে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করতেন।

সুমিত ও রোহিত দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল। খুলনা জিলা স্কুল থেকে বড় ছেলে সুমিত আগামি বছর এসএসসি দেবে। ছোটটি ক্লাস সিক্সে পড়ে। বড়টির তুলনায় ছোটটি বেশী মেধাবি। বড়টিকে বিএসএস দিয়ে সিভিল/পুলিশ প্রশাসনে ক্যাডার সার্ভিস করানোর বাসনা ছিল, আর ছোটটিকে ডাক্তারি পড়ানোর ভীষণ ইচ্ছা। সরকারিতে যদি চান্স না পায় তবে বেসরকারিতে পড়ানোর খুব স্বপ্ন ছিল। এর খরচ সম্পর্কে আমাকে জিগ্যেস করতো।

আহামরি অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ ছিল না সুবীরদা’র। ভীষণ চাপা স্বভাবের এই মানুষটি নিজের কষ্ট, সংসারের অভাব-অনটনের কথা খুব বেশী শেয়ার করতো না। বৌদিকে হেটে হেটে ছেলেদের স্কুলে আনা-নেয়ার কষ্টটাও তিনি লুকিয়ে রাখতে চাইতেন।

পত্রিকা অফিস থেকে রাত ১২/১টায় বাড়ী ফিরতেন। খুলনা বেতারে অনুষ্ঠান থাকলে খুব ভোরে সেখানে চলে যাওয়া। এরপর বাড়ী এসে তৈরী হয়ে আবার কলেজে ক্লাস নেয়া। বিকেলে আবার সাংবাদিকতায় মনোনিবেশ করা। ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনকে সময় দেয়া। অফিসের বিশেষ এ্যাসাইনমেনট থাকলে সেটি সম্পন্ন করে সন্ধ্যার পর আবারো পত্রিকা অফিসে কাজ করা। এসব কিছুর মধ্যেই সন্তানদের মানুষ করতে তিনি একটি বা দু’টি প্রাইভেট ব্যাচ পড়ানোর কথা কিছুদিন ধরে আমার সাথে শেয়ার করছিলেন। আবার সময় কই তাই তিনি চিন্তাটিকে দুরে সরিয়ে রাখতেন।

স্বাস্থ্য নিয়ে গত কয়েক বছরে তাঁর সচেতনতা দেখেছি। আমাদের অনেককে সাথে নিয়ে শহীদ শেখ আবু নাছের হাসপাতালে চেকআপ করিয়ে আসতেন। কয়েক বছর ধরে ঘাড়ের নীচে স্পাইনাল কডে সমস্যার কারণে ঘাড় ঘোরাতে ফিরাতে অসুবিধা হতো। ডায়বেটিস ছিল না। তবে  হাইপ্রেসার ছিল। রাতে কম ঘুম হওয়ার কারণে ক্লান্তিতে প্রেস ক্লাবসহ অনেক জায়গায় ঘুমিয়ে পড়তো মুখ হা করে।

গত কয়েক মাসে তাঁর শারীরিক অবস্থা দেখে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। ফুসফুসে সমস্যার কারণে শ্বাস কষ্ট হতো। মাঝে-মাঝে কলকাতা গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসতো। গত কয়েকমাস ধরে দেখছিলাম তাঁর খাওয়া-দাওয়া আগের মতো নেই। মাঝে-মধ্যে এবং পত্রিকায় অফ-ডে থাকলে বাসস অফিসে এসে আমার ল্যাপটপে নিউজ পাঠাতো।

খুলনা বেতারের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রতিদিনের সংবাদপত্র নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান সমাচারে সুবীরদা ছিলেন একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক। তাঁর দরাজ গলায় উপস্থাপনা শ্রোতারা পছন্দ করতেন। গত ২৯ আগষ্ট সুবীরদা আমার সাথে শেষ অনুষ্ঠানটি করেছিলেন। তাঁর শরীর এবং চোখ-মুখের অবস্থা দেখে তাঁকে বললাম আপনিতো খুব অসুস্থ। শিঘ্রি ভালোভাবে চিকিৎসা করান। সংবাদপত্রের শিরোনাম পড়তে গিয়ে বারবার হাপিয়ে উঠছিলেন। গলা থেকে মাঝে-মধ্যে স্বর বেরুচ্ছিল না। অনুষ্ঠান শেষে আমাদের নিয়মিত শ্রোতা ও সিনিয়র সাংবাদিক জ্যোতির্ময় মল্লিক ফোন করে বললেন সুবীর শিঘ্রি তুমি ডাক্তারের কাছে যাও। চিকিৎসা নাও। অনুষ্ঠান শেষে দু’জন একসাথে এ্যাড: মন্জুরুল ইমামের বাড়ীর পেছনের বাজারে যাই। সুবীরদা পূজার ফুল, দু’টি আম কিনলেন। কাল (৩০শে আগষ্ট) কলকাতায় চিকিৎসা করাতে যাবেন বলে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

গত ২০ বছরে অনেক স্মৃতি। দেশ-বিদেশের মাটিতে অনেক আনন্দ করেছি। সবার সাথে মেলামেশা করার মতো অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। কারো বিপদে-আপদে সাধ্যমত উপকার করতেন। নিজের কষ্টের কথা সাধারণত শেয়ার করতে চাইতেন না।

৪ঠা সেপ্টেম্বর বিকেলে মিন্টু ভাইয়ের টেলিফোন পাই। কান্নাভেজা কন্ঠ। জাহিদ খবর জানো-সুবীর ক্লিনিক্যালি ডেড। সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে আসো। সেখানে প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাহেব আলী ভাই চূড়ান্ত দু:সংবাদ শোনালেন। রাতে সাংবাদিকরা ছুটে যাই পূর্বাঞ্চল-এর বন্ধুদের সমবেদনা জানাতে। এরই মধ্যে অসুস্থ ফেরদৌসি ভাবী এসে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে থাকেন।

লেখক-খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও স্বাধীনতা সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক।

 

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *