November 25, 2024
জাতীয়লেটেস্ট

৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয়

একে তো করোনা মহামারির ধকল, তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সবমিলিয়ে এক টালমাটাল অবস্থা পার করছে বিশ্ব অর্থনীতি। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যে। সারাবিশ্বেই অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে জ্বালানির দাম। অবস্থা সামাল দিতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করেছে অধিকাংশ দেশ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

বিদ্যুৎ ব্যবহার সাশ্রয় করতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে গত ১৯ জুলাই থেকে শিডিউল করে সারাদেশে লোডশেডিং কার্যক্রম শুরু করে সরকার। একই সঙ্গে এসির ব্যবহার কমানো, দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহারের লক্ষ্যে অফিস সময় এগিয়ে আনা ও কমানো হয়েছে। এর সুফলও মিলেছে। জনগণের মধ্যে সাশ্রয়ী মনোভাব গড়ে উঠেছে, বিদ্যুতের চাহিদা কমে এসেছে অন্তত দেড় হাজার মেগাওয়াট। ফলে লোডশেডিংও ধীরে ধীরে কমে আসছে।

জ্বালানি সাশ্রয়ে প্রাথমিকভাবে মোট চাহিদার দুই হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয় সরকার। শিডিউল করে লোডশেডিং ও জনসচেতনতা বাড়িয়ে এ ঘাটতি সমন্বয়ের কার্যক্রম হাতে নেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে দেড় মাসের মাথায় লোডশেডিং কমে এসে ঠেকেছে প্রতিদিন ৫০০ মেগাওয়াটে। অন্যদিকে সাশ্রয়ের পরিমাণ ঠিকই দুই হাজার মেগাওয়াট হচ্ছে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা কমে আসবে ধারণা করে লোডশেডিং স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। অর্থাৎ যে ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হচ্ছে, সেটিরও প্রয়োজন পড়বে না।

জানা গেছে, জুলাইয়ে যখন লোডশেডিং কার্যক্রম শুরু হয়, তখন দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল প্রতিদিন ১৫ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনা ছিল, প্রতিদিন দুই হাজার মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা। অর্থাৎ চাহিদা ১৫ হাজার থাকলেও ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করে বাকি দুই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং ও নানা উদ্যোগের মাধ্যমে সমন্বয় করা। সেই জায়গা থেকে প্রথম অবস্থায় পরিকল্পনা ছিল প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হবে। এতে করে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম খরচ হবে। আর বাকি এক হাজার মেগাওয়াট জনগণের সচেতনতা ও নানা উপায়ে সাশ্রয় করা হবে। কিন্তু সে পরিকল্পনা শুরুতে বাস্তবায়ন না হওয়ায় এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং করার কথা থাকলেও এর অতিরিক্ত লোডশেডিং করা হয়। এভাবে দেড় হাজার মেগাওয়াট বা তার বেশি লোডশেডিংভিত্তিক সাশ্রয় করা হয়েছে। বাকি অল্পকিছু (সাশ্রয়) নানা উপায়ে এসেছে। তবে বর্তমানেও সাশ্রয় দুই হাজার মেগাওয়াটই হচ্ছে, কিন্তু লোডশেডিং করতে হচ্ছে ৫০০ মেগাওয়াট। বাকি দেড় হাজার মেগাওয়াট আরও বিভিন্ন কার্যক্রম ও জনগণের সচেতনতার অভ্যাস গড়ে ওঠার মাধ্যমে সমন্বয় হচ্ছে। বিষয়টা ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সংকটের কারণে আমরা প্রতিদিন দুই হাজার মেগাওয়াট সাশ্রয় করার টার্গেট নিয়ে কাজ শুরু করি। অর্থাৎ উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদার দুই হাজার মেগাওয়াট গ্যাপ রাখা। তখন পরিকল্পনা ছিল এমন যে, এক হাজার মেগাওয়াট আমরা লোডশেডিং করবো। আর বাকি এক হাজার মেগাওয়াট আমরা বিভিন্ন উপায়ে কমাবো। তার মধ্যে রয়েছে, রাত ৮টায় দোকানপাট বন্ধ করা, সাধারণ গ্রাহকদের সাশ্রয়ী হতে আহ্বান জানানো, অপচয় কমানো, অপ্রয়োজনে বিদ্যুৎ খরচ বন্ধ করা, আলোকসজ্জা বন্ধ করা, অপ্রয়োজনে এসি না চালানো- এসব পদক্ষেপ। কিন্তু আমরা দেখলাম, এভাবে এক হাজার মেগাওয়াট সাশ্রয় হতো না। কারণ, প্রথমদিকে গ্রাহকরা সচেতনতার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেননি। এজন্য ওই কর্মসূচিতে মাত্র ৫০০ মেগাওয়াট সাশ্রয় হতো। যার কারণে লোডশেডিং করে এক হাজারের বদলে দেড় হাজার মেগাওয়াট বা তার বেশি সাশ্রয় করার প্রয়োজন দেখা দিলো।

 আগে দিনে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি ছিল, আবার রাতে কমে যেতো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টায় চাহিদা আগের মতোই আছে। কিন্তু তুলনামূলক দিনের চাহিদা কমে গেছে

তিনি বলেন, প্রথম অবস্থায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বা তার বেশি সাশ্রয় করতে আমরা এক ঘণ্টার জায়গায় অতিরিক্ত লোডশেডিং করলাম। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে রুটিন মেনে দোকানপাট বন্ধ রাখা, অফিস সময় কমিয়ে আনা, মানুষের সচতনতার অভ্যাস হওয়া, অপচয় কম করা- এসব বাস্তবায়নের কারণে পরিবর্তন হলো। ফলে লোডশেডিংয়ের পরিমাণও কমে আসে।

কীভাবে লোডশেডিং সমন্বয় করা হচ্ছে জানতে চাইলে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমরা দেখলাম ঢাকা শহরে বিদ্যুতের চাহিদার পিক টাইম রাত ৮টা থেকে ১০টা। কিন্তু রাত ৮টায় দোকান বন্ধ করার নিয়ম যখন চালু হলো, তখন সেই চাহিদা এসে দিনে বিকেল ৫টায় হয়ে গেলো। অর্থাৎ যে ডিমান্ড (চাহিদা) রাত ৮টায় ছিল, সেটি নেমে ৫টায় আসলো। এরপর আমরা দেখলাম দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান খাতে একদিনে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। আমরা চিন্তা করলাম, সাপ্তাহিক ছুটি সব একদিনে হওয়ার পরিবর্তে যদি প্রতিদিনই শিডিউল করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখি, তবে বিদ্যুতের চাহিদার চাপ একদিনের বদলে প্রতিদিন সমানভাবে পড়বে। এতে নির্দিষ্ট এক দিনের ওপর চাপ কমে যাবে। সেভাবেই আমরা যখন এলাকাভিত্তিক শিডিউল করলাম, তখন দেখলাম আগে যে কর্মসূচিতে ৫০০ মেগাওয়াট সাশ্রয় ছিল, সেখানে সাশ্রয়ের পরিমাণ বেড়ে এক হাজার মেগাওয়াটের কাছে চলে আসছে। এর পর আমাদের সরকারি অফিস ও ব্যাংকগুলো অফিস টাইম পরিবর্তন করলো। এর ফলে আমরা দেখলাম, রাত ৮টার যে পিক টাইম বিকেল ৫টায় চলে আসছিল, সেখান থেকে (চাহিদা) আরও নেমে আসছে। এভাবে চাহিদা কমে আসছে।

 আগে যেখানে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট, সেখান থেকে এখন চাহিদা কমিয়ে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াটে আনা হয়েছে। আর আমরা উৎপাদন করছি ১৩ হাজার মেগাওয়াট। বাকি ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে সমন্বয় করা হচ্ছে

জনগণ ধীরে ধীরে সচেতন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগে দেখতাম দিনে চাহিদা বেশি ছিল, আবার রাতে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যেতো। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টায় চাহিদা আগের মতোই আছে। কিন্তু তুলনামূলক দিনের চাহিদা কমে গেছে। অর্থাৎ মানুষ আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাশ্রয়ী হয়েছে। রাতে প্রয়োজনে ফ্যান বা এসি ব্যবহার করছে। আর দিনে বন্ধ রাখছে। এতে করে যেখানে সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট, সেখানে অফিসের সময় কমিয়ে আনা, দোকানপাট আগে বন্ধ করা, শিল্পকারখানা শিডিউল করে বন্ধ রাখার ফলে চাহিদা কমে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াটে নেমে এসেছে। বাকি ৫০০ মেগাওয়াট আমরা লোডশেডিং করছি।

একক মাসে বা পুরো লোডশেডিং সময়ে কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হলো- এমন প্রশ্নে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, তা হিসাব করে বলার উপায় নেই। কারণ, আমাদের প্রতিদিনের হিসাব প্রতিদিনের মতো করে। বিষয়টা এমন না যে বিদ্যুৎ জমা করে রাখছি। প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে, প্রতিদিন সরবরাহ হচ্ছে। আমাদের জন্য ইতিবাচক দিক হলো, আগে যেখানে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াট, সেখান থেকে এখন চাহিদা কমিয়ে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াটে আনা হয়েছে। আর আমরা উৎপাদন করছি ১৩ হাজার মেগাওয়াট। বাকি ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে সমন্বয় করা হচ্ছে।

এদিকে, সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে লোডশেডিং কমিয়ে আনা হবে বলে বারবার ঘোষণা দিয়ে আসছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খণিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

এ ঘোষণা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, লোডশেডিং সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এর কারণ হলো সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় এসির চাহিদা কিছুটা কমে যায়। এর ফলে বিদ্যুতের চাহিদাও কমে যাবে। এতে করে লোডশেডিং স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের কোনো পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ নেই। ডিজেলভিত্তিক যেগুলো বন্ধ করা হয়েছিল, সেগুলো চালু করা হয়েছে। আর গ্যাসভিত্তিক যেগুলো অর্ধেক চালু-অর্ধেক বন্ধ রাখা হয়েছিল, সেগুলোও সেভাবেই চলছে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *