৩৭ লাখ টাকা আত্মসাতের জন্যই ছিনতাই নাটক!
ভিবোর ওই শো-রুমটি ছিল ‘হ্যালো রাজশাহী-২ এর একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। মোবাইল ফোন নেওয়ার জন্য আগাম টাকা পাঠানোর কথা ছিল ব্যাংকে। ৩৭ লাখ টাকা ব্যাংকে জমার দেওয়ার কথা জানতেন ওই শো-রুমের দুই বিক্রয় প্রতিনিধি (এসআর)।
তাই প্রতিষ্ঠানটির সেই টাকা আত্মসাতের জন্য সাজানো হয় ছিনতাই নাটক। ওই দুই যুবকের সঙ্গে যোগ দেন তার আরও দুই বন্ধু। কোনো রকম রক্তপাত বা ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া ৩৭ লাখ টাকা ছিনতাইও হয় নাটকীয় স্টাইলে। আর সেখানেই সন্দেহ হয় পুলিশের।
ঘটনার পর সিসি টিভির ফুটেজে ওই দুই বিক্রয় প্রতিনিধির নিষ্ক্রীয়তা দেখার পর তাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই উদ্ধার হয় ছিনতাই হওয়া ৩২ লাখ টাকা। হ্যালো রাজশাহী-২ নামের মোবাইল প্রতিষ্ঠানের বাকি ১ লাখ টাকা এখনও মেলেনি। তবে এত নাটক সাজানোর পরও শেষমেশ ধরা পড়েছেন তারা।
জড়িত চার যুবকের মধ্যে তিনজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অপরজন পলাতক। উদ্ধার করা হয় ৩২ লাখ টাকা। বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) দুপুরে ওই টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তবে আট ঘণ্টার মধ্যে রাজশাহী মহানগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানার সেনপুকুর এলাকা থেকে ছিনতাইয়ের টাকাগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।
পরে ছিনতাই রহস্যর উন্মোচন করতে শুক্রবার (১৯ জুন) দুপুরে মহানগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ। সেখানে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে পুরো ছিনতাইয়ের ঘটনার বর্ণনা দেন।
এ সময় রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) উপ-কমিশনার সাজিদ হোসেন, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবদুর রশিদ, আরএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (সদর) গোলাম রুহুল কুদ্দুস, বোয়ালিয়া থানার সহকারী কমিশনার ফারজিনা ইয়াসমিন, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিবারন চন্দ্র বর্মন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মহানগরীর কর্ণহার থানার দারুশা সায়েরপুকুর এলাকার মিজানুর রহমানের ছেলে মেহেদী হাসান ফায়সাল (২৬), শাহ মখদুম থানার দক্ষিণ নওদাপাড়া এলাকার দুলাল হোসেনের ছেলে তাইজুল ইসলাম ওরফে ডলার (২৪) এবং দামকুড়া থানার হরিপুর গ্রামের মৃত হাসান আলীর ছেলে আরিফুল ইসলাম ওরফে ডলার (২৪)। পলাতক অন্য আসামির নাম অহিদুল ইসলাম (২২)। কাশিয়াডাঙ্গা থানার সেনপুকুর এলাকায় তার বাড়ি। বাবার নাম আবদুল ওহাব। বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) রাত ৯টার দিকে আরিফুলের ঘর থেকেই টাকাগুলো উদ্ধার করা হয়।
এর মধ্যে মেহেদী হাসান ফায়সাল রাজশাহীর ভিভোর শো-রুমের বিক্রয় প্রতিনিধি (এসআর)। আর তাইজুল ইসলাম ডলারও সেখানকার কর্মচারী। তবে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে তিনি শো-রুমে কম আসতেন। মূলত তাইজুলই এ ঘটনার মাস্টার মাইন্ড। তিনিই পুরো ছিনতাই নাটক সাজান।
এছাড়া পলাতক থাকা আসামি আরিফুরের বাবা একজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। গত বছর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনায় তার মৃত্যু হয়।
মহানগরীর বোয়ালিয়া থানায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ভিভোর শো-রুমের জন্য নতুন কিছু ফোন নিতে বৃহস্পতিবার ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার কথা ছিল।
শো-রুমের প্রোপাইটর অঞ্জন কুমার রায় তার কর্মচারী মেহেদী হাসান এবং সিম্ফনির ডিস্ট্রিবিউশনের ম্যানেজার সোহেলকে টাকাগুলো ব্যাংকে জমা দিতে পাঠান।
শো-রুম থেকে কয়েক মিনিটের পায়ে হাঁটা দূরত্বেই ডাচ বাংলা ব্যাংক। কিন্তু শো-রুম থেকে টাকা নিয়ে বের হয়ে রাস্তায় তারা যখন হাঁটা শুরু করেন তখন দুই যুবক মোটরসাইকেল নিয়ে এসে মেহেদীর কাঁধে থাকা ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে চলে যান। এরপর বিষয়টি ছিনতাই বলে প্রচার করে মেহেদী। ঘটনার পর সিসি টিভির ফুটেজ দেখে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তখনই বুঝতে পারে এটা সাজানো নাটক।
পুলিশ জানায়, আরিফুল ও তাইজুল মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছিলেন। তারা দু’জনেই মাথায় হেলমেট পরে ছিলেন। আর পরনে ছিল রেইন কোট।
মেহেদীর সঙ্গে আগে থেকেই তাদের সব পরিকল্পনা ঠিক ছিল। সে অনুযায়ী মোটরসাইকেলের পেছনে বসে তাইজুল টান দিয়ে টাকার ব্যাগ নেন। সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আরিফুলকে টাকা দিয়ে পাঠিয়ে তাইজুল আবার মোটরসাইকেল নিয়ে ভিভোর শো-রুমের সামনে আসেন। তখনই পুলিশ তাকে আটক করে।
এছাড়া মেহেদী ও সোহেলকেও আটক করা হয়। পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাইজুল স্বীকার করেন তারা পরিকল্পনা করেই টাকা নিয়ে গেছেন। তবে এ ঘটনার সঙ্গে সেলিম জড়িত নন। তাই পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। ব্যাংকে টাকা নেওয়ার সময় সেলিমের কাছে ব্যাগে ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৮০০ টাকা ছিল। এই টাকাগুলো কথিত ছিনতাইয়ের সময় নিয়ে যাওয়া হয়নি। শুধু মেহেদীর কাছে থাকা ব্যাগের ৩৩ লাখ টাকা নিয়েছিল।
পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মেহেদীও জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোটরসাইকেলের চালক আরিফুল ইসলামকে আটক করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বন্ধু অহিদুল ইসলামের বাড়ি থেকে ৩২ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এর আগে সকালেই তাইজুলের কাছ থেকে ছিনতাই নাটকে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি জব্দ করা হয়। তবে ছিনতাইয়ের মোট ৩৩ লাখ টাকার মধ্যে এক লাখ টাকা নিয়ে অহিদুল ইসলাম পলাতক আছেন।
এ ঘটনায় মহানগরীর অলোকার মোড়ের হ্যালো রাজশাহী-২ মোবাইল ফোনের শো-রুমের প্রোপাইটর অঞ্জন কুমার রায় বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন।