December 23, 2024
জাতীয়

২৪ শতাংশ গাড়ির ফিটনেস গ্রহণযোগ্য নয়

দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
২৪ শতাংশ যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট সঠিক নাই বা গ্রহণযোগ্য নয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যানবাহনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফিটনেস জরিপ করতে আদালতের নির্দেশে গঠিত একটি জাতীয় নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি ৮৩টি যানবাহন জরিপ করে এমন প্রতিবেদন দিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে ছিলেন, রিটকারী আইনজীবী তানভীর আহমেদ। বিআরটিএ-এর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী রফিকুল ইসলাম।
পরে তানভীর আহমেদ বলেন, আদালত একটি জরিপ কমিটি করতে বলেছেন। সেটা তিন মাসের মধ্যে করেছেন। বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান এ জরিপ প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩৩ ভাগ বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট নাই। ৫৬ ভাগ বাসে স্পিড গভর্নর সিল নেই। (৩৯টি বাসের মধ্যে ১৩টি বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট সঠিক নাই/গ্রহণযোগ্য নয়। ২২টি বাসের স্পিড গভর্নর সিল নাই।)
তিনি বলেন, ‘আদালত বলেছেন, এটার পূর্ণাঙ্গ শুনানির দরকার। এখন সেটা ফিক্স করতে হবে। জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ৩১ জুলাই হাইকোর্ট একটি কমিটি করতে নির্দেশ দেন। কমিটির জরিপ প্রতিবেদন তিন মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু সচিব এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওই সময় তানভীর আহমেদ আরও বলেছিলেন, রুলে ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বন্ধে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বন্ধে গণপরিবহনের ফিটনেস নিশ্চয়তা ও নজরদারিতে বিবাদীদের ব্যর্থতাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। এ আদেশ অনুসারে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রওশন আরা বেগমকে আহŸায়ক করে ১৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, গাজীপুরের হাইওয়ে পুলিশ সুপার মো. শফিকুল ইসলাম, পুলিশের এআইজি (টিএম) এ কে এম মোশারফ হোসেন মিয়াজী, বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মো. মাহবুব-ই-রব্বানী, এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মো. মুহসীন রেজা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব (সীমান্ত-৩) আরিফ আহমেদ খান, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (রোড সেফটি বিভাগ) মোহাম্মদ শাহীন সরকার, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (টিইসি) মো. সাইদুর রহমান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আবুল কালাম, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সহ-সভাপতি মো. ছাদিকুর রহমান সরকার, ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল­াহ ভুলূ, বুয়েটের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এহসান, বুয়েটের এআরআই’র সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিক-কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ ও বিআরটিএর সচিব মো. আব্দুস সাত্তার।
এ কমিটি গত বছরের ২০ নভেম্বর গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় ১২টি যানবাহন, ২৭ নভেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রামের মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে বিভিন্ন শ্রেণির ১৭টি, ৫ ডিসেম্বর মাওয়া রোডের মুন্সীগঞ্জের নীমতলায় ২৩টি এবং ১১ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগরের স্টেশন রোড, বনানীতে ৩১টিসহ মোট ৮৩টি যানবাহনের ওপর জরিপ পরিচালনা করে।
এর মধ্যে ৩৯টি বাস, ২২টি ট্রাক ও ২২টি সিএনজি চালিত অটোরিকশা রয়েছে। যানবাহনের লুকিং গ্লাস, সিগন্যাল লাইট, ব্রেক লাইট, সিএনজি অটোরিকশার বিভিন্ন বিষয়ে জরিপ করে।
জরিপের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় বর্তমান সময়ে সবচাইতে আলোচিত সমস্যাসমূহের মধ্যে উলে­খযোগ্য হলো সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনা কোনো একটি কারণে ঘটে না বরং এর সাথে বিভিন্ন বিষয় জড়িত থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি মোটরযানের ফিটনেস সার্টিফিকেট মেয়াদ থাকাটাই ফিটনেস বোঝায় না। বিআরটিএ’র নিয়ম অনুযায়ী একটি গাড়িকে প্রতি বছর একবার ফিটনেসের পরীক্ষা সম্পন্ন করে সার্টিফিকেট নিতে হয় এর পরবর্তী এক বছরের মধ্যে সার্টিফিকেট থাকা অবস্থায় ওই গাড়ির যে কোনো ত্র“টি হতে পারে। অন্যদিকে বছরের পর ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন না করার বিষয়টি রয়েছে। অর্থাৎ একদিকে ফিটনেস সার্টিফিকেট সম্বলিত গাড়ি যেমন ত্র“টিপূর্ণ হয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে অন্যদিকে ত্র“টিপূর্ণ গাড়িও এই ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ নিবন্ধিত গাড়ির যানবাহনের সংখ্যা ৩৮ লাখ, যা প্রতিনিয়িত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সাথে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা।
জরিপের বিষয়ে বলা হয়, একটি গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার সময় ৫৯টি আইটেম পর্যবেক্ষণ করতে হয়। যেহেতু কমিটিকে জরিপটি সড়কের একটি স্থান নির্ধারণ করে যাত্রীবাহী বাস বা মালবাহী ট্রাক থামিয়ে করতে হবে, সেহেতু ৫৯টি বিষয় কখনই দেখা সম্ভব নয়। তাই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি চেকলিস্ট তৈরি করে সড়ক দুর্ঘটনার সাথে জড়িত এমন ৩২টি বিষয় সন্নিবেশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের পর্যালোচনার অংশে বলা হয়েছে, দ্বৈবচয়নের ভিত্তি জরিপটি সাপ্তাহিক কর্ম দিবসে পরিচালনা করা হয়েছে। গণপরিবহন, পণ্য পরিবহন ও সিএজি চালিত অটোরিকশাসহ মোট ৮৩টি যানবাহনের ওপর এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। যাত্রী দূর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জরিপের সময় হ্রাস করা হয়েছে।
যানবাহনের অনেক বিষয় রয়েছে, যা পর্যবেক্ষণের জন্য পরীক্ষণ যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। কিন্তু সার্ভে টিমের কাছে এ ধরনের যন্ত্রপাতি না থাকায় চোখের দেখায় অনুমান নির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তাছাড়া, একটি গাড়ির ব্রেক সঠিক আছে কিনা তা ওই গাড়িকে কিছুটা চালিয়ে তারপর ব্রেক পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু ব্যস্ত সড়কে এ কাজটি করার সুযোগ না থাকায় তা করা সম্ভব হয়নি।
সার্ভে পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা, মালিক-শ্রমিক সংগঠন, পুলিশ সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়। ধারণা করা হয় যে, সার্ভে করার বিষয়টি কোনো

না কোনোভাবে প্রকাশ হওয়ায় অনেক যানবাহন (সম্ভবত খারাপ যানবাহন) ওই স্থান ও সময় এড়িয়ে চলেছে বলে প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে উলে­খ করা হয়েছে।
প্রাপ্ত জরিপে ৮৩টি মোটরযানে যে সব বিষয় তুলনামূলকভাবে খারাপ রয়েছে তা হলো— ২৪ শতাংশ যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট, ৪১ শতাংশ যানবাহনের স্পিড গভর্নর সিল, ২৭ শতাংশ যানবাহনের সিএসজি সিলিন্ডারের মেয়াদ, ২৯ শতাংশ যানবাহনের বাহ্যিক অবস্থা, ৩০ শতাংশ যানবাহনের ইন্ডিকেটর লাইট, ৩০ শতাংশ যানবাহনের সিগন্যাল লাইট, ২৯ শতাংশ যানবাহনের ব্রেক লাইট, ৪৫ শতাংশ যানবাহনের ‘৯৯৯’ স্টিকার, ৯০ শতাংশ যানবাহনের বাম্পার ও ৯৫ শতাংশ যানবাহনের এঙ্গেল।
অপরদিকে যে সকল বিষয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো আছে তা হলো—৮০ শতাংশ যানবাহনের চেসিসের অবস্থা, ৭৬ শতাংশ ফিটনেস সার্টিফিকেট, ৯৬ শতাংশ যানবাহনের চাকার রাবারিং অবস্থা, ৮৯ শতাংশ দরজা, ৯৪ শতাংশ সিট, ৯০ শতাংশ জানালা, ৯৫ শতাংশ যানবাহনের হেডলাইট, শতভাগ যানবাহনের ব্রেক অবস্থা, ৯৬ শতাংশ যানবাহনের স্টিয়ারিং, ৮০ শতাংশ যানবাহনের স্পিডোমিটার, ৮৩ শতাংশ যানবাহনের টেম্পারেচারগেজ।
প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়েছে, জরিপ থেকে প্রাপ্ত ফলাফর বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যায় যে, প্রায় সব দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী যানবাহনের ফিটনেসের অবস্থা ভালো এবং যানবাহনের বিভিন্ন অংশের মান সংখ্যার দিক থেকে সর্বনিম্ন ৭০ থেকে সর্বোচ্চ ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত সঠিক রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা শতভাগ পর্যন্ত ভালো পাওয়া গিয়েছে। তবে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ ফলাফল বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে না।
প্রতিবেদনের সুপারিশ অংশে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি প্রতিরোধে ও সড়কে শৃঙ্খলা আনয়নে আনফিট বা ত্র“টিপূর্ণ যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এ বিষয়ে সমস্যার ব্যাপকতা ও মাত্রা বোঝার জন্য যানবাহনের বিশেষ করে গণপরিবহনের ওপর বিজ্ঞানবিভিত্তিক একটি সার্ভে পরিচালনা করা খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে কোনো বিশষায়িত গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা পরিচালনা করা যেতে পারে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *