১৫ আগস্টের আগেও হত্যার চেষ্টা হয় শেখ কামালকে : প্রধানমন্ত্রী
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
বাংলাদেশের স্বাধীনতার তিন বছর পার না হতেই জাতির পিতার বড় ছেলে ক্যাপ্টেন শেখ কামালকে যে ‘হত্যার চেষ্টা’ করা হয়েছিল, তাতে সফল না হয়ে যেভাবে ‘অপপ্রচার’ চালানো হয়েছিল, সেসব কথা তার জন্মদিনে স্মরণ করলেন তার বোন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের ৭২তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন’ এবং ‘শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার ২০২১’ প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এ বিষয়ে কথা বলেন সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটা চক্রান্ত করে কামালকে গুলি করা হয়। তাকে হত্যারও চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সে যখন বেঁচে যায়, তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়। অথচ রাষ্ট্রপতির ছেলে বা প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, জাতির পিতার ছেলে অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করত। কখনো বাবা প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি- সেইজন্য অর্থ সম্পদের দিকে তার কোনো দৃষ্টি ছিল না। ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে তার কোনো দৃষ্টি ছিল না।
দেশকে গড়ে তোলা, দেশের মানুষের পাশে থাকা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সাংস্কৃতিক অঙ্গন বা ক্রীড়া অঙ্গন- এইসব কিছুর উন্নতি করা, এটাই ছিল তার সব থেকে বড় কথা। অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করত। আবুল ফজল সাহেব একটা লেখা লিখেছিলেন, সেটা যদি কেউ পড়েন, তাহলে দেখবেন যে কীভাবে কামালকে তিনিৃ তার যে অমায়িকতা, সাদাসিধে জীবনযাত্রা, চলাফেরা সেটাই তিনি তুলে ধরেছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামাল ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, ‘স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনও তিনি গড়ে তুলেছিলেন।
ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসাবে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন শেখ কামাল। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যও ছিলেন তিনি। কামাল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ ভর্তি হয়েছিলেন শেখ কামাল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের গুলি করে হত্যা করা হয়। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ঝরে যায় শেখ কামালের জীবন। তার স্ত্রী অ্যাথলেট সুলতানা খুকুকেও সেদিন রেহাই দেয়নি ঘাতকের বুলেট।
বিলাস-ব্যাসনে কখনো শেখ কামালের মন ছিল না জানিয়ে তার বোন শেখ হাসিনা বলেন, আমার বাবার শিক্ষা ছিল, মায়ের শিক্ষা ছিল। আর তাছাড়া একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সেখানে তো বিলাসিতার কোনো সুযোগ নেই। আর ব্যবসা বাণিজ্য, অর্থ সম্পদ এই সব দিকে তার কোনো নজরই ছিল না।
পাকিস্তান আমালে শোষিত বঞ্চিত বাঙালির অধিকার আদায়ে আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনের অনেকটা সময় কারাগারেই কাটাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। সে কারণে তার সন্তানরা পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হলেও সেই কষ্টকে কখনো কষ্ট মনে করেননি বলেও মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, আমার মা সেটা করতে দেননি বা কোনো হা-হুতাশ বা কোনো চাওয়া বা অতিরিক্ত কিছু চাওয়া সেটা ছিল না। সাধারণভাবে জীবন যাপন করা, একটা আদর্শ নিয়ে চলা এবং দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা, দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করা- এটাই আমাদের শিক্ষা। সেই শিক্ষাই কামাল সব সময় অনুসরণ করেছে।
স্বাধীনতার পর দেশের ক্রীড়া অঙ্গনকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে শেখ কামালের ভূমিকার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যে আধুনিক ফুটবল খেলা বা ক্রিকেট খেলা বা এই যে খেলাধুলা, সেটাকে একটা আধুনিকতার ছোঁয়া এবং সংগীত জগতে বা সাংস্কৃতিক জগতে, সেখানেও তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে সে অনেক অবদান রেখে গেছে আমাদের সমাজের জন্য।
শেখ হাসিনা দুঃখ করে বলেন, জাতির পিতা আজীবন শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন, অথচ এদেশেরই কিছু মানুষ ষড়যন্ত্র করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।
সব থেকে ট্র্যাজেডি কামালের জন্য, যে নূর (বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরী) আর কামাল একসাথে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে কাজ করেছে, যখন বাসা আক্রমণ করে কামাল নিচের বারান্দায় চলে যায়, ও যখন দেখে নূর, হুদা- এরা এক সাথে ঢুকছে, তখন তাদেরকে বলেছিল, ‘আপনারা এসে গেছেন খুব ভালো হয়েছে। দ্যাখেন বাসা কারা আক্রমণ করেছে’। এই কথা শেষ করতে পারেনি, ওই নূরের হাতের অস্ত্রই গর্জে ওঠে। ওখানেই কামালকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা এই বাংলাদেশে ঘটে গেছে। ১৫ আগস্ট যদি আজকে বাঙালির জীবনে না ঘটত, তবে এই বাঙালি অনেক আগেই বিশ্বে একটা মর্যাদা নিয়ে চলত। এবং এই হত্যার পর বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশে ঘোষণা দিয়েছিল, যদিও সেটা টেকে নাই। কাজেই চক্রান্তটা কোথায়, কীভাবে ছিল সেটা নিশ্চয় দেশের মানুষ এখন এতদিনে উপলব্ধি করতে পারে। আর কতবড় বিশ্বাসঘাতকতা, সেটাও নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারেন।
শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের ৭২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রথমবারের মতো যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় প্রবর্তিত এই পুরস্কারের জন্য সাতটি ক্যাটাগরিতে মোট ১০ জন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ও দু’টি প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের শহীদ শেখ কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। টোকিও অলিম্পিক গেমস থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল।
ক্রীড়াবিদ হিসেবে রোমান সানা (আরচ্যারি), মাবিয়া আক্তার সীমান্ত (ভারত্তোলন), মাহফুজা খাতুন শিলা (সাঁতার), ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে মনজুর কাদের (শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব) এবং ক্যা শৈ ল হ্ন (কারাতে ফেডারেশন), উদীয়মান ক্রীড়াবিদ হিসেবে আকবর আলী (ক্রিকেট) ও ফাহাদ রহমান (দাবা), উন্নতি খাতুন (ফুটবল), ফেডারেশন/অ্যাসোসিয়েশন/সংস্থা ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, আজীবন সম্মাননায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিন এবং ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে মুহাম্মদ কামরুজ্জামান এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ওয়ালটন শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার লাভ করে।
পুরস্কার হিসেবে প্রত্যককে এক লাখ টাকা, ক্রেস্ট ও সম্মাননা সনদ দেয়া হয়। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আক্তার হোসেন অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তিনিই বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
অনুষ্ঠানে শেখ কামালকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার তানভীর মাজাহার তান্না এবং আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশীদ বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে শহীদ শেখ কামালকে নিয়ে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থের মোড়কও উন্মোচন করেন। শেখ কামালের জীবন ও কর্মের ওপর অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয় এবং তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।
দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ জে এফ জয়