হালদা থেকে ‘রেকর্ড’ সাড়ে ২৫০০০ কেজি ডিম সংগ্রহ
চট্টগ্রামের হালদা নদী থেকে এবার সাড়ে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, যা ২০০৬ সালের পর সর্বোচ্চ।
শুক্রবার হালদায় যে ২৮০টি নৌকা নিয়ে ডিম সংগ্রহ করা হয় তার মধ্যে থেকে তিনটার দিকে ১৩১টি নৌকার তথ্য নিয়ে গড় হিসাবের ভিত্তিতে ডিমের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে জেলা মৎস্য অধিদপ্তর।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, ২৮০টি নৌকায় ৬১৬ জন আহরণকারী মোট ২৫৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছেন।
“১৩১টি নৌকার তথ্য নেয়া হয়েছে। বড় নৌকাগুলোর তথ্য আমরা নিইনি। মাঝারি আকারের নৌকাগুলোর প্রতিটিতে সর্বনিম্ন ২-৪ বালতি থেকে সর্বোচ্চ ১২ বালতি পর্যন্ত ডিম পেয়েছে।”
“এবার প্রচুর ডিম পাওয়া গেছে, সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ চলেছে।”
তবে আহরণকারীদের কারো কারো এই পরিমাণ ডিম সংগ্রহের বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত আছে। হালদার উজানের দিকের নৌকাগুলোতে বেশি ডিম আহরণ হলেও ভাটির দিকে কম ছিল বলে জানিয়েছেন তারা।
গত বছর প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম থেকে রেণু মিলেছিল ২০০ কেজি। এর আগে ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়, যা থেকে রেণু মিলেছিল ৩৭৮ কেজি। ছবি: সুমন বাবু
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “২০০৬ সালে ৩২৭২৪ কেজি ডিম পাওয়া পর এবারই সর্বোচ্চ ২৫৫৩৬ কেজি ডিম মিলল। ২০০৭ সালে ২২৩১৪ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। সে হিসেবে ১৪ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি।”হালদা দূষণকারী এশিয়ান পেপার মিল ও হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট এক বছর ধরে বন্ধ থাকা, মানিকছড়িতে তামাক চাষ ৭০ শতাংশ বন্ধ হওয়া, মা মাছ রক্ষায় টানা অভিযান এবং করোনাভাইরাসের চলমান লকডাউনের শুরুতে কর্ণফুলী তীরের শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকায় (হালদা গিয়ে কর্ণফুলীতে মিশেছে) এবার ভালো ডিম পাওয়া গেছে। আম্পানের কারণে গত দুদিন হালদায় সাগরের নোনা পানির আধিক্য ছিল। আজ সকালেও ছিল। জোয়ারের সময় সেটা কমায় তখন বেশি ডিম পাওয়া গেছে।
এই পরিমাণ ডিম থেকে কত কেজি রেণু উৎপাদিত হবে জানতে চাইল ড. মনজুরুল বলেন, “সরকারি হ্যাচারি ও মাটির কুয়োর তথ্য সংগ্রহ করে সেটা রেণু ফোটার পরই বলা যাবে। এজন্য একটি কমিটি আছে। সেই কমিটি সেটা জানাবে পরে।”
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় শুক্রবার সকাল সাতটার দিকে মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। এসময় নদীতে ভাটা ছিল।
তার আগে বৃহস্পতিবার রাতে নদীতে নমুনা ডিম ছাড়ে মা মাছ, সেদিন বিকাল থেকেই নৌকা নিয়ে নদীতে অবস্থান নেয় ডিম আহরণকারীরা।
সকালে ভাটার সময় ডিমের পরিমাণ কম থাকলেও বেলা ১২টার দিকে জোয়ারের সময় মা মাছ আবার ডিম ছাড়ে, এরপরই বাড়ে আহরণের পরিমাণ।
নদীর হাটহাজারী ও রাউজান অংশের আজিমের ঘাট, অংকুরি ঘোনা, কাগতিয়ার মুখ, গড়দুয়ারা নয়াহাট, রাম দাশ মুন্সির ঘাট, মাছুয়া ঘোনা ও সত্তার ঘাটসহ বিভিন্ন অংশে ডিম আহরণ করা হয়।বছরের এই সময়ে (এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত) বজ্রসহ বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল নামলে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে জোয়ার ও ভাটার সময়ে নিষিক্ত ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে অমাবস্যার তিথি শুরু হয়।
গড়দুয়ারা অংশের ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর বলেন, “সকালে একদম কম ছিল। পরে দুপুরে বেশি ডিম ছাড়ে, সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত ছয় নৌকায় মোট ৪৫ বালতি ডিম পেয়েছি। আরও ডিম ছিল, আর ধরতে পারিনি। গতবারের চেয়ে এবার বেশি ডিম পেয়েছি।”
মাদার্শা এলাকার ডিম আহরণকারী আশু বড়ুয়া জানান, ছয়টি নৌকা নিয়ে ১২ বালতির মত ডিম পেয়েছেন তিনি, পরিমাণ গতবারের চেয়ে বেশি।
হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন বলেন, গত দেড় বছর ধরে হালদায় টানা অভিযান চালিয়ে অবৈধ জাল, ইঞ্জিন বোট ও বালুবাহী ড্রেজার ধ্বংস করা হয়েছে। সবার সম্মিলিত চেষ্টার ফলে এবার গতবারের চেয়ে বেশি ডিম পাওয়া গেছে।
ডিম ফুটিয়ে রেণু উৎপাদনে হালদা পাড়ের সরকারি-বেসরকারি সব হ্যাচারি ও কুয়া প্রস্তুত আছে।
এর মধ্যে শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত হাটহাজারীর মদুনাঘাট হ্যাচারিতে ১৬০০ কেজি, শাহমাদারি হ্যাচারিতে ১১৫০ কেজি এবং মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে ২১২০ কেজি ডিম নিয়ে এসেছে বলে জানান জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা রনি।
এই তিন হ্যাচারিতে মোট ১১৭টি কুয়া আছে। এর বাইরে উপজেলায় মাটির কুয়া আছে ৭৩টি।রাউজান উপজেলার মোবারকখিল সরকারি হ্যাচারির ৫০টি কুয়া এবং ব্যক্তিগত ৬৮টি মাটির কুয়া প্রস্তত আছে।
গত বছর ২৫ মে রাতে গভীর ডিম ছাড়ে মা মাছ, সংগ্রহ করা হয় ২৬ মে সকালে। প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম থেকে রেণু মিলেছিল ২০০ কেজি। প্রেতি কেজি রেণু ৮০ হাজার টাকা দর হিসাবে যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এর আগে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়, যা থেকে রেণু মিলেছিল ৩৭৮ কেজি।
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির হিসাব মতে, ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল ১৬৮০ কেজি ডিম পাওয়া যায় হালদায়।
২০১৬ সালের ২ মে নমুনা ডিম মেলে ৭৩৫ কেজি। ওই বছর তিনবার নমুনা ডিম দিলেও আর ডিম ছাড়েনি মা মাছ।
২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল ও ১২ জুন দুই দফায় মিলে মোট ২৮০০ কেজি, ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল ১৬৫০০ কেজি, ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ৪২০০ কেজি এবং ২০১২ সালে ২১২৪০ কেজি ডিম মেলে হালদায়।