November 27, 2024
জাতীয়লেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

হলি আর্টিজান হামলা, পরের ৬ বছরে গ্রেফতার ২৪১০ জঙ্গি

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য জঙ্গি হামলার ছয় বছর ১ জুলাই। ২০১৬ সালের এই দিনে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও প্রায় ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস জিম্মিদশার ঘটনা স্তম্ভিত করেছিল পুরো জাতিকে।

১ জুলাই রাত থেকে পরদিন (২ জুলাই) সকাল পর্যন্ত এ জঙ্গি হামলায় পুলিশের দুই কর্মকর্তা ও ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জন নিহত হন। ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ নিকেশ হয় হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি।

এই ঘটনার পর পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গি-উগ্রবাদ মোকাবিলায় জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেন। শুরু হয় একের পর এক জঙ্গিবিরোধী অভিযান। হলি আর্টিজান হামলার পর গত ছয় বছরে এক হাজারের বেশি অভিযান চালিয়ে সর্বমোট ২ হাজার ৪১০ জন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়।

হলি আর্টিজান হামলা পরবর্তী ধারাবাহিক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বর্তমান প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় দেশে জঙ্গিবাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই মুহূর্তে বড় ধরনের কোনো জঙ্গি হামলার হুমকি ও আশঙ্কা নেই। হলি আর্টিজান হামলার পর জঙ্গিদের সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

২০১৩ সাল থেকে ব্লগার, লেখক-প্রকাশক, বিদেশি নাগরিক ও ভিন্ন ধর্ম বা মতালম্বীদের ওপর ‘টার্গেটেড কিলিং’ চলার মধ্যেই ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজিম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট নামে নতুন জঙ্গিবিরোধী ইউনিট গঠন করা হয়। এছাড়া, ধারাবাহিকভাবে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)।

যারা জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি ‘সফট অ্যাপ্রোচের’ মাধ্যমে জঙ্গিদের পুনর্বাসন, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। হামলার সক্ষমতা হারালেও বর্তমানে অনলাইন প্ল্যাটফর্মেই জঙ্গিদের সবচেয়ে বেশি তৎপরতা রয়েছে, বিষয়টি চিহ্নিত করে অনলাইন প্লাটফর্মকে গুরুত্ব দিয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি চালানো হচ্ছে।

সিটিটিসির অভিযানে গ্রেফতার ৫৫৯ জঙ্গি

সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, হলি আর্টিজান হামলার পর গত ছয় বছরে জঙ্গি সংগঠনগুলোর ৫৫৯ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে জেএমবি’র ৯৯ জন, নিউ জেএমবি’র ২০৪ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ১৩৬জন, হরকাতুল জিহাদের ১০জন, হিযবুত তাহরীরের ৩৪ জন, সংগঠন উল্লেখ নাই এমন উগ্র ও সহিংসতায় বিশ্বাসী ৭৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার ১ হাজার ৬৭৮ জঙ্গি

হলি আর্টিজান হামলার পর পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের ৭৭৯ অভিযানে গ্রেফতার করা হয় ১ হাজার ৬৭৮ জঙ্গিকে। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার জঙ্গিদের মধ্যে জেএমবির ৮৩৬ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৮৬ জন, হুজির ৩০ জন, হিযবুত তাহরীরের ৮৮ জন, শহীদ হামজা ব্রিগেডের ১ জন, আনসার আল ইসলামের ৪০৬ জন, আল্লাহ’র দলের ২০১ জন, মানহাজীর ১ জন ও গায়েরী এহসারের ১ জন।

এটিইউ অভিযানে গ্রেফতার ১৭৩

হলি আর্টিজান হামলার পরই দেশজুড়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযান ত্বরান্বিত করতে ২০১৭ সালে পুলিশের বিশেষায়িত ইউটিন এটিইউ’র অনুমোদন দেয় সরকার। প্রতিষ্ঠার পর ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাহিনীটির পরিচালিত ১০৮ অভিযানে ১৭৩ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। করেছে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট। এর মধ্যে জেএমবি’র ১৪ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৪৮ জন, আল্লাহ’র দলের ৩১ জন, হিজবুত তাহরীরের ২৫ জন, আনসার আল ইসলামের ২৪ জন ও অন্যান্য ২০ জন।

জঙ্গিদের পুনর্বাসন

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরামর্শে র‌্যাবই প্রথম জঙ্গিদের আত্মসমর্পনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। শুরু হয় বিপথগামী জঙ্গি সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা। র‌্যাবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রথমে বগুড়া, রংপুর, কুষ্টিয়াতে আত্মসমর্পন করেন ৭ জন বিপথগামী তরুণ। ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি ‘নব দিগন্তের পথে’ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ৬ জন জেএমবির এবং ৩ জন আনসার আল ইসলামের সদস্য ‘বিনাশর্তে’ আত্মসমর্পণ করে। ‘র‌্যাব ডি-রেডিক্যালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল (আরডিআরসি)’ এর মাধ্যমে জঙ্গিদের সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে বাহিনীটি। এর বাইরে ইতোমধ্যে ৮ জঙ্গিকে পূর্নবাসন করেছে সিটিটিসি।

এছাড়া, দেশজুড়ে সকল পর্যায়ের সকল শিক্ষার্থীদের একত্রিত করে জঙ্গিবাদ বিরোধী জনসচেতনামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে সিটিটিসি। জঙ্গিবাদ সম্পর্কে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা নিয়ে কাজ করছে বাহিনীটি। বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত সেমিনার, ওয়ার্কশপ, বির্তক প্রতিযোগিতা পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও বর্তমানে প্রত্যেক জেলায় জনসচেতনামূলক পথনাটক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সুশীল সমাজ, গণ্যমান্য ধর্মীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত জনসচেতনামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাব বহুমুখী কর্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ দমনে কাজ করছে। যখনই জঙ্গিরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে তখনই গ্রেফতার করা হচ্ছে। শুধুমাত্র অভিযান নয়, জঙ্গিবাদ বিরোধী জনমত গড়তে ও জনসম্পৃক্ততা অর্জনে র‌্যাব ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা করেছে। অন্যদিকে গ্রেফতারের পাশাপাশি জঙ্গিদের অর্থের উৎস এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রাপ্তি বন্ধ করতেও র‌্যাবের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, একদিনেই কেউ জঙ্গি হয়ে উঠে না। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় তার যে পরিবর্তন আসে সেটা যদি খেয়াল রাখি তাহলে বিস্তার রোধ করা সম্ভব। আর কেউ যদি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায় তাহলে আমরা স্বাগত জানাই।

প্রত্যক্ষ জঙ্গি কার্যক্রম বা হামলা হচ্ছে না বলে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই উল্লেখ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী সিকদার বলেন, জঙ্গি সংগঠনগুলো অনলাইন প্লাটফর্মে ব্যাপকভাবে সক্রিয়। ছোট-খাটো হামলা করে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিক্রিয়া ও সক্ষমতাও পরীক্ষা করে দেখছে। দেশে ধর্মান্ধকতার ঝুঁকি বেড়েছে, এতে করে উদ্বুদ্ধকরণের কাজটা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সহজ হয়েছে। জঙ্গিরা বসে নেই, তাদের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক, রাজনৈতিক সংশ্লেষও আছে। এসব ভেঙে দিতে হবে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *