November 25, 2024
জাতীয়লেটেস্ট

সিঙ্গাপুরে ওবায়দুল কাদের

উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রখ্যাত চিকিৎসক দেবী শেঠীর পরামর্শ

দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
গুরুতর অসুস্থ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার বিকাল সোয়া ৪টায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজোবেথ হাসপাতালের একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদেরক নিয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে।
বাংলাদেশ সময় রাত ৭টা ৫০ এ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি সিঙ্গাপুরে পৌঁছায়। পরে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ওবায়দুল কাদেরকে মাউন্ট এলিজোবেথ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে আইসিউতে ভর্তি করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েলফেয়ার অফিসার মো. আল আমিন হোসেন জানিয়েছেন। স্ত্রী ইশরাতুন্নেসা কাদের এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. আবু নাসের রিজভী সিঙ্গাপুরে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে রয়েছেন।
ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুরের পথে কাদেরকে দেখভাল করার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন মাউন্ট এলিজোবেথ হাসপাতালের দুজন চিকিৎসক, একজন নার্স ও একজন টেকনিশিয়ান। রোববার সন্ধ্যায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গেই ঢাকায় এসেছিলেন তারা।
রোববার সকালে শ্বাসকষ্ট নিয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ভর্তি হন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পরে এনজিওগ্রামে তার হৃদপিণ্ডের রক্তনালীতে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটি ব্লক স্টেন্টিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ করার পর কাদেরের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও পরে আবার অবনতির দিকে যায়। চিকিৎসকরা তখন কৃত্রিমভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেন।
৬৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদকে তখন থেকেই ক্রিটিক্যাল করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভেন্টিলেশনে (কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার ব্যবস্থা) রাখা হয়। সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে একটি চিকিৎসক দল রোববার সন্ধ্যায় ঢাকায় এলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যাত্রা পিছিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের চিকিৎসকরা।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের তরফ থেকে ভারতের প্রখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন দেবী প্রসাদ শেঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সোমবার দুপুরে ঢাকায় এসে তিনি কাদেরের অবস্থা দেখে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তার সঙ্গে পরামর্শ করে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের চিকিৎসকরা ওবায়দুল কাদেরকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত দিলে বিকালেই কাদেরকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়।
দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, এখন সবাই রেডি আছি। সিঙ্গাপুরের টিমের উপর নির্ভর করছে কখন সেখানে যাবেন। যত দ্রুত সম্ভব তাকে নিয়ে যাওয়া হবে। এর আধা ঘণ্টার মাথায় করোনারি কেয়ার ইউনিটের সুবিধা সম্বলিত একটি অ্যাম্বুলেন্স ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে পুলিশি পাহারায় বিমানবন্দরের পথে রওনা হয়।
আগেই পুরো রাস্তা খালি করে দেওয়ায় বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনালে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ২০ মিনিট। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকাল সোয়া ৪টায় রওনা হয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্স।
রোববার সকালে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর দুপুরের দিকে চিকিৎসকরা বলেছিলেন, তার অবস্থা ‘সঙ্কটজনক’। আর সন্ধ্যায় তারা বলেন, অবস্থার সামান্য উন্নতি হওয়ায় ওবায়দুল কাদের ডাকে সাড়া দিয়ে চোখ মেলতে পারছেন, তবে এখনও অবস্থা শঙ্কামুক্ত বলা যাবে না।
রোববার সন্ধ্যায় সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কাদেরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে রাতে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্য বলেন, সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় তখুনি সিঙ্গাপুরে না নিয়ে দেশেই চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে সিসিইউতে রাতে ওবায়দুল কাদেরের অবস্থার আরও একটু উন্নতি হয়। আওয়ামী লীগ নেতা বিপ্লব বড়ুয়া সকালে জানান, ওবায়দুল কাদেরের চেতনা ‘পুরোপুরি ফিরেছে’।
এদিকে সরকারের ডাকে দুপুরে ভারত থেকে উড়ে আসেন ভারতের নারায়ণ ইন্সটিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেসের প্রতিষ্ঠাতা ডা. দেবী শেঠী, যার ১৫ হাজারের বেশি অস্ত্রোপচার করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তিনি ওবায়দুল কাদেরের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে মতামত দিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে ওবায়দুল কাদেরকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর অনুমতি দেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের চিকিৎসকরা।
সেই সিদ্ধান্ত জানাতে দুপুরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ডা. মিল্টন হলে ব্রিফিংয়ে এসে ওবায়দুল কাদেরের সর্বশেষ অবস্থা, তার শারীরিক জটিলতা এবং রোগের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন চিকিৎসকরা।
কাদেরের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান কার্ডিওলজির অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক অসিত বরণ অধিকারী এবং উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন এই ব্রিফিংয়ে।
ডা. আলী আহসান বলেন, সকাল ৯টার পর থেকে ওবায়দুল কাদেরের অবস্থা অনেকটা স্থিতিশীল হয়ে আসে। রক্তচাপ, ইলেকট্রোলাইটস, রক্তের পিএইচ এবং রক্তে চিনির পরিমাণ স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। প্রগ্রাবের পরিমাণও মোটামুটি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
উনি বেশ নড়াচড়া করছিলেন, ভেন্টিলেটর খুলে দেওয়ার জন্য ইংগিত দেখাচ্ছিলেন। এতে বোঝা যায় উনি বেশ ভালো আছেন। আমরা ঘুমের ওষুধ দিয়ে তার এই কষ্টটা লাঘব করছি। সব কিছু মিলিয়ে বলা যায়, উনার পজিশন এখন স্টেবল আছে এবং উন্নতির দিকে যাচ্ছে।
তবে কাদের শ্বাসতন্ত্রের জটিল রোগ সিওপিডিতে (ক্রনিক অবসট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) ভুগছেন জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, উনার ভেন্টিলেটর ও মেশিন, যেটা সাপোর্ট দেওয়া আছে, এটা উইথড্র করতে একটু সময় লাগবে।
অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ওবায়দুল কাদের অনেক আগে থেকেই ডায়াবেটিস এবং রক্তচাপে ভুগছিলেন কিন্তু তা নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ করা হত না। উনার হার্টে আগেও একটা অ্যাটাক হয়েছিল। উনাকে স্টেন্টিং করার জন্য আগেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। গত ২০ ডিসেম্বর উনি আসার পর একটা মেডিকেল বোর্ড গঠন করে দিই, তখন ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ইলেকশনের আগে উনি ভর্তি হন নাই। তাছাড়া সেতুমন্ত্রীর রক্তে সংক্রমণ ছিল বলেও তথ্য দেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্য।
এখন কাদেরের অবস্থা শঙ্কামুক্ত কি না- এই প্রশ্নে অধ্যাপক অসিত বরণ অধিকারী বলেন, “শঙ্কামুক্ত শব্দটা আপেক্ষিক আজকে উনার অবস্থা কালকের চেয়ে অনেক ভালো।” হৃদরোগে আক্রান্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দেখতে সোমবার দুপুরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে আসেন ভারতের কার্ডিয়াক সার্জন দেবী প্রসাদ শেঠী।
অধ্যাপক কনক কান্তি বলেন, সোমবার সকালে ওবায়দুল কাদেরের অবস্থা স্থিতিশীল হয়ে আসার পর উনারা ঠিক করেন, এখন তাকে বিদেশে পাঠানো যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে ডা. দেবী শেঠীকে এনে একবার দেখানোর অনুরোধ থাকায় তারা সময় নেন।
একটি চার্টার করা প্লেনে করে বেলা পৌনে ১টায় ঢাকায় পৌঁছান ডা. দেবী শেঠী। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে গিয়ে ওবায়দুল কাদেরের চিকিৎসার সব কাগজপত্র ও ডাক্তারি পরীক্ষার ফলাফল তিনি পর্যালোচনা করেন।
শুরু থেকে কী কী উপসর্গ ছিল, কখন কীভাবে অবস্থার ওঠানামা হয়েছে, সে সময় কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এনজিওগ্রামে কী পাওয়া গেছে, রাতে তার পরিস্থিতি কেমন ছিল, সবকিছু খুটিয়ে শোনেন প্রখ্যাত এই ভারতীয় চিকিৎসক।
কাদেরের জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক এ সময় উপস্থিত ছিলেন। কনক কান্তি বলেন, সব কিছু দেখে তিনি (দেবী শেঠী) উনাদের উপস্থিতিতে এ কথাটাই বললেন, ‘হোয়াটএভার ডান ইয়েট বাই ইওর কার্ডিয়াক টিম ইজ অ্যান এক্সিলেন্ট জব।’
ভাবি, মানে মিসেস ওবায়দুল কাদের ছিলেন। উনাকে বললেন, ‘ইউর হাজবেন্ড ইজ লাকি, উনারা এই এক্সিলেন্ট টিম যেসব উদ্যোগ নিয়েছে এতক্ষণ পর্যন্ত, উনাকে এই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে, ইউ নো, আমেরিকাতেও এর চেয়ে বেশি কিছু করার নাই’।
সব কিছু সঠিক পথে থাকার পরও ওবায়দুল কাদেরকে বিদেশে পাঠানোর কারণ হিসেবে পরিবারের আগ্রহ এবং বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে অতিরিক্ত ভিড়ের কথা বলেন উপাচার্য। তিনি বলেন, পরে কোনো জটিলতা দেখা দিলে সেতুমন্ত্রীকে সিঙ্গাপুরে পাঠাতে সমস্যা হত। সে কারণে এখনই তাকে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। এ বিষয়ে ডা. দেবী শেঠীর মতামত নেওয়ার পর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। তিনিও তখন তাতে সম্মতি দেন বলে জানান অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *