সর্বজনীন পেনশন নিয়ে যা ভাবছেন অর্থনীতিবিদরা
দেশের সব নাগরিককে পেনশন সুবিধার আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই পেনশন-সুবিধা পেতে ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর প্রিমিয়াম বা চাঁদা দিতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় ১৮ বছর বা তার বেশি বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক অংশ নিতে পারবেন। বিশেষ বিবেচনায় পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা এর আওতায় থাকতে পারবেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরাও এতে অংশ নিতে পারবেন। অংশগ্রহণকারী তার ৬০ বছর বয়স থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন।
তবে প্রিমিয়ামের হার কত হবে, তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। আইন হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটি নির্ধারণ করবে। মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দেওয়া যাবে এবং অগ্রিম ও কিস্তিতেও চাঁদা দেওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে সরকারের এখানে কি পরিমাণ কন্ট্রিবিউশন থাকবে সে বিষয়ে এখনও স্পষ্ট করা হয়নি। তাই বিষয়টি নিয়ে কিছু সমালোচনায়ও হচ্ছে।
সর্বজনীন এ পেনশন দেওয়ার লক্ষ্যে সম্প্রতি জাতীয় সংসদে একটি বিলও পাশ হয়েছে। এখন এটি নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। তার অনুমোদন পেলেই এটি আইনে পরিণত হবে।
কী ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত বিলটি অনেকটা ব্যাংকের ডিপিএসের মতো মনে হচ্ছে। এখানে সরকারের কি পরিমাণ কন্ট্রিবিউশন থাকবে তা স্পষ্ট করা করা হয়নি। পেনশন তহবিলে জমা টাকার ব্যবহার বা ভবিষ্যৎ কি হবে তা সেগুলোও স্পষ্ট করা দরকার।
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) প্রধান নির্বাহী ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে বিধিমালা না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। সরকার এখানে কিভাবে এই তহবিলটি ব্যবস্থাপনা করবে, সেটার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। বিশেষ করে কোথায় কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে, তাতে কতটা রিটার্ন পাওয়া যাবে, এসবের ওপর ফান্ডের সাফল্য নির্ভর করবে।
তিনি বলেন, সরকার বয়স্ক গরিব মানুষদের জন্য একটি বিশেষ প্যাকেজ চালু করতে পারে। অন্তত বৃদ্ধ বয়সে যেন তাকে খাদ্যে বা ওষুধের চিন্তা করতে না হয়। মোট কথা সমাজের প্রত্যেকটা মানুষ যেন এর সুবিধা পায়।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ফান্ডের অর্থ সুরক্ষা রাখতেও আইন করতে হবে। এই ফান্ডের অর্থ সরকারও যেন নিতে না পারে। বিশেষ প্রয়োজনে সরকার এই অর্থ নিলে তার জন্য ইন্টারেস্ট দিতে হবে। একইসঙ্গে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় টাকা রাখলে তার ইন্টারেস্ট দ্বিগুণ দিতে হবে।
উল্লেখ্য, আইনটি সংসদে পাশ হলেও পেনশনের জন্য কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, চাঁদার হার কি হবে, সেসব বিষয় এখনো ঠিক করা হয়নি। যদিও সরকার বলছে, পরবর্তীতে যে বিধিমালা তৈরি করা হবে, সেখানে এসব বিষয় উল্লেখ করা হবে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে ফান্ডিংয়ের পুরো সিস্টেম কিভাবে হবে তা স্পষ্ট হলে বোঝা যাবে। যেহেতু এটি দেশের সব নাগরিকের জন্য, সুতরাং এখানে কারো কোনো প্রভাব যেন না থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
যা বলা হয়েছে খসড়া আইনে
চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে মাসিক পেনশন পাবেন। চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন দেয়া হবে। একজন পেনশনার আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। সরকার গেজেট জারি করে বাধ্যতামূলক না করা পর্যন্ত এ পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ হবে ঐচ্ছিক।
বিলে বলা হয়েছে, পেনশনে থাকাকালীন কোনো ব্যক্তি ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়ের জন্য (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেয়ার আগে মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
পেনশন তহবিলে জমা দেয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন, যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। পেনশন থেকে পাওয়া অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে।
বিলে আরও বলা হয়েছে, নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। বিলে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরতদের অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। তবে সরকার সিদ্ধান্ত না দেয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা এ পেনশন ব্যবস্থার আওতাবহির্ভূত থাকবেন।
বিলে একটি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এ কর্তৃপক্ষে একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য থাকবেন। এদের নিয়োগ করবে সরকার।