May 3, 2024
লেটেস্টসম্পাদকীয়

শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার চিন্তা: যে প্রশ্নগুলি বিবেচনা করা যেতে পারে

আমরা একটি অস্থির সময় পার করছি। অস্থির এই সময়ে, আমরা দেখছি, মানুষে মানুষে সদ্ভাব নেই, চারিদিকে হিংসা হানাহানির ক্রমবর্ধমান বাড়বাড়ন্ত। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, শহর-বন্দর, পাড়া-মহল্লা সর্বত্র একটা ইদুর দৌড়। সবাই ছুঁটছে। কে কাকে ফেলে আগে যাবে, কিমবা নিজেকে অ্যাটলিস্ট চলমান ইদুর দৌড়ে টিকিয়ে রাখবে, তার এক বিরামহীন তোড়জোড়। সর্বত্র লাগামহীন অসহিষ্ণুতার এক ক্রমবর্ধিষ্ণু ক্ষয়। মানুষের কাজ আছে, অর্থ আছে, ঘর আছে, প্রিয়জন আছে, কিন্তু সবকিছু থাকলেও তারমধ্যে কী যেন একটা কিছু অনুপস্থিত। মানুষ যেন কোনোভাবেই আর সুখি হতে পারছে না, শান্তিতে থাকতে পারছে না, স্থির থাকতে পারছে না; তাকে ঘীরে থাকছে শঙ্কা, তাকে ঘীরে থাকছে অনিশ্চয়তা, তাকে ঘীরে থাকছে নিরাপত্তাহীনতার নিষ্ঠুর এক বোধ।

আমরা সম্প্রীতি চাইছি, সৌজন্য চাইছি, রাষ্ট্রেরাষ্ট্রে বন্ধুত্ব চাইছি, বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিস্পত্তি চাইছি; আমরা একের সাথে অন্যের ভালবাসা চাইছি, মিল ও মহব্বত চাইছি; কিন্তু কীভাবে সহমর্মিতা, ভালবাসা ও শ্রদ্ধার চর্চা করতে হয় তার সূত্র যেন হারিয়ে গেছে। সেটা আর শেখা হয়ে উঠছে না। আমরা বলছি মানুষে মানুষে সংহতি থাকবে, ভালবাসা থাকবে, ত্যাগ থাকবে; এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে আক্রমণ করবে না। পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতার বোধ বজায় রাখবে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে, কীসে যে সেটা নিশ্চিত হবে, তার প্রকৃত একটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যাচ্ছে না। আমরা বলছি মানুষ প্রয়োজনের মুহুর্তে সমস্বরে এক সুরে কথা বলবে, সংকটে কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করবে, কিন্তু বাস্তবে, হচ্ছে তার একেবারেই উল্টোটা। মানুষ, সংকটে বরং একটি সিন্ডিকেট বানিয়ে ফেলছে। সিন্ডিকেট করে সাধারণের পকেট কাটার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ফেলছে। কোভিডের মত মহামারির সময়েও সেটা দেখা গেছে। কেন এমন হচ্ছে? সাধারণভাবে দেখলে দেখা যাবে যে, মোটাদাগে সুশিক্ষা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আকালই এর কারণ।

আমরা মনে করি, আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে থেকেই মুল সমস্যাটি সৃষ্টি হয়ে পরবর্তীতে তা সুশাসনের অভাবহেতু বিকশিত হয়ে একদিন মহিরুহ হয়ে যাচ্ছে। খোলাচোখে, প্রতিনিয়ত আমরা যা দেখছি সেটা সমস্যা নয়, সমস্যা আদতে অন্যত্র। আমরা যা দেখছি সেটা ফলাফল, প্রকৃত কারণ সুশিক্ষা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আকাল। আমরা আসলে শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে প্রকৃত মানুষ হতে পারছি না। পরিবার যদি শিক্ষার সবটুকু আয়োজন সম্পন্ন করতে পারতো, তাহলেতো আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। ফলে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ ঠিক করতে হবে। সেখানে মানুষ হতে গিয়ে আমরা যথাযথভাবে তা হতে পারছি কীনা সেটা দেখতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে মানুষ হওয়ার যথাযথ বীজ-মন্ত্র থাকতে হবে। আমাদের প্রতিষ্ঠানসমূহকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আর প্রতিষ্ঠানসমুহ যাতে সেটা নিশ্চিত করতে পারে তার জন্য রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে সেটার প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে।

বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষা হল পরবর্তী প্রজন্মের নেতা, উদ্ভাবক এবং চিন্তাবিদদের জন্য একটি ইনকিউবেটর। এভাবে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষাস্তরকে আমাদের ঢেলে সাজাতে হবে। প্রতিটি স্তরের প্রতিটি শিক্ষার কিছু লক্ষ্য উদ্দেশ্য সেট করা থাকে, সেগুলি প্রতিপালিত হচ্ছে কীনা সেটা দেখতে হবে। স্বস্ব স্তরে, শিক্ষার সেই সমস্ত লক্ষ্য উদ্দেশ্যসমূহ অর্জিত হচ্ছে কীনা, সেটা দেখতে হবে। কেন এত মসজিদ মন্দির এত প্রার্থনা প্রতিষ্ঠানের পরও মানুষ নৈতিকভাবে সৎ হচ্ছে না, হতে পারছে না তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। কেন এত সুন্দর সুন্দর আইনকানুন প্রবর্তনের পরও মানুষকে সিস্টেমে রাখা যাচ্ছে না, সেগুলো আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। একাজে প্রবৃত্ত হলেই আমরা দেখবো, আমাদের সংকটের উৎপত্তি স্থল রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে, যার সংস্কার প্রয়োজন। অতএব শিক্ষাসংস্কার কাজ শুরুর প্রারম্ভে যে প্রশ্নগুলি মাথায় রেখে শুরু করা যেতে পারে তাহলো: ১. শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে সুকুমার বৃত্তির বিকাশ হচ্ছে কি? ২. নিয়ত পরিবর্তশীল বিশ্বে প্রতিমুহুর্তের কাজের জন্য যে দক্ষতাটুকু প্রয়োজন, তার অর্জন নিশ্চিত হচ্ছে কি? ৩. প্রতিযোগিতামূলক যে বিশ্ব, সেখানে টিকে থাকার সংগ্রামে যে সাংকল্পিক বোধ প্রয়োজন, তা শিক্ষার্থীর মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে কি?

শেয়ার করুন: