‘লকডাউনে’ বিদ্যুতের ব্যবহার কমে অর্ধেক
কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে জনজীবনে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে দেশে বিদ্যুতের ব্যবহার নেমে এসেছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেকে।
কলকারখানা বন্ধ থাকায় চাহিদা কমে গেলেও বিভিন্ন স্থানে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘরবন্দি মানুষের বিরক্তির কারণ হচ্ছে।
এমনকি খোদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও কর্মকর্তাদের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন- “এখন কেন লোড শেডিং হবে?”
বিতরণ সংস্থাগুলো অবশ্য একে লোডশেডিং বলছে না। তাদের ভাষ্য, কালবৈশাখী ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাতেই মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ যাচ্ছে।
বরং এই পরিস্থিতিতে দেশের বিদ্যুৎ খাত সামনে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে বর্তমানে সচল ১৩৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট। এর বিপরীতে বছরের এমন সময়ে দিনে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহারেরও রেকর্ড রয়েছে।
তবে গত ২৬ মার্চ থেকে অফিস-আদালত, কল-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিদ্যুতের ব্যবহার ৭ হাজার মেগাওয়াটে নেমে এসেছে বলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপক সাইফুল হাসান চৌধুরী জানান।
তিনি বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহে দিনে গড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছিল। গত কয়েক দিনে মেঘ-বৃষ্টি শুরু হওয়ায় কনজাম্পশন কমে সাত হাজার মেগাওয়াটে এসেছে।”
পিডিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত ২৪ এপ্রিল দিনের সর্বোচ্চ চাহিদা (অফ পিক) ছিল ৫ হাজার ৭৬৯ মেগাওয়াট, সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ (পিক আওয়ার) চাহিদা ছিল ৭ হাজার ৮৯ মেগাওয়াট। ২৫ এপ্রিল ৬ হাজার মেগাওয়াট থেকে সাড়ে ৮ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে ওঠানামা করেছে বিদ্যুতের চাহিদা।
এর মধ্যেই শুরু হয়েছে রোজার মাস। অন্য বছর তারাবির সময় দোকান, শপিংমলসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক স্থাপনা বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও এবার তেমন কোনো ঘোষণা দিতে হচ্ছে না।
তবু বিভ্রাটকলকারখানা বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা উদ্বৃত্ত পড়ে থাকলেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন গ্রাহকরা।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকদের কাছ থেকে যেমন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের খবর পাওয়া গেছে, তেমনি অভিযোগ এসেছে নরসিংদী, কুমিল্লা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও।
গত ২০ এপ্রিল বিদ্যুৎ বিভাগ এবং এর অধীনস্ত কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, “অনেক জায়গা হতেই লোড শেডিং বা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকার অন্যতম বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসির অপারেশন শাখার নির্বাহী পরিচালক হারুনুর রশিদ বলেন, “সম্প্রতি ঝড়বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া অন্য কোনো কারণে ঢাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটেনি। গত পরশুও বেইলী রোড ও ধানমন্ডি এলাকায় ঝড়ে বড় বড় গাছ পড়ে বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এগুলো প্রতিবছর ঝড়ের মওসুমেই হয়ে থাকে।”
কোথাও এখন লোড শেডিং হচ্ছে না বলে জোর দাবি জানান তিনি।
কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এজিএমে শ্যামল কুমার মল্লিক বলেন, সম্প্রতি কালবৈশাখী ঝড়ে পেকুয়া এলাকায় বেশ কিছু খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেগুলো মেরামত করতে প্রায় দুই দিন সময় লেগে যায়। সে কারণে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল।
“কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এর সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও বিপণন করতে পারছে না এখন। গ্রিডেও পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকছে। ফলে এখানে লোড শেডিং হওয়ার প্রশ্নেই আসে না।
দেশে ব্যবহার হওয়া মোট বিদ্যুতের ৬০ শতাংশ ব্যয় হয় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ৮০টি সমিতির অঞ্চলগুলোতে। সেখানেও চাহিদা কমে অর্ধেক হয়ে গেছে বলে জানান বোর্ডের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সদস্য অঞ্জন কান্তি দাস।
তিনি বলেন, “বিদ্যুতের অভাবে লোড শেডিং হচ্ছে ব্যাপারটি মোটেও এরকম নয়। তবে কালবৈশাখী ঝড় হলে কোথাও কোথাও দেড় থেকে দুই ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকছে।… যেখানে গাছ পড়ে গিয়ে লাইন ট্রিপ করে সেখানে খুব বেশি সময় লাগে না।”
লকডাউনের মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা ও ব্যবহার যে মাত্রায় কমেছে তাতে পল্লী বিদ্যুৎ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অঞ্জন।
তিনি বলেন, “গত মাসে পিডিবির বিল দেওয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩শ কোটি টাকা। এ মাসের বিল যে কীভাবে দেওয়া হবে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। মার্চ মাসে ৩০ শতাংশ গ্রাহক বিল পরিশোধ করেছে। এপ্রিল মাসে ২০ শতাংশ বিল আসবে বলেও মনে হচ্ছে না “
পিডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে অনেক বিতরণ সংস্থারই রেভিনিউ কালেকশন কমে গেছে। কোনো ধরনের বিলম্ব ফি আরোপ না করে কীভাবে এ সময়টা পার করা যায় সেই আলোচনাও চলছে।
“দেনা-পাওনাগুলো আপাতত বিবেচনা করা হবে না। কারণ এ ধরনের বিপর্যয় আগে কখনও হয়নি। বিল নিয়ে তাই আপাতত কোনো সমস্যা হবে না। আগামী তিন মাস বিলে বিলম্ব সংক্রান্ত কোনো সুদ বা বিলম্ব ফি ক্লেইম করা হবে না।”
ক্ষতি ‘কয়েক স্তরে’বিদ্যুৎখাতের গবেষণা ও তদারককারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহা পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন মনে করেন, লকডাউনের কারণে সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে ক্ষতির ধাক্কা আসবে, তার বড় অংশীদার হবে বিদ্যুৎ খাত। এই খাতে ক্ষতি হবে কয়েক স্তরে।
প্রথমত বিদ্যুৎ ব্যবহার কমে যাওয়ায় প্ল্যান্টগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত গ্রাহকদের কাছে বিল জমে যাচ্ছে, এখন তাড়া দেওয়া যাচ্ছে না। অনেক বিল হাতে আসবে দেরিতে, তাতে নগদ টাকার টান পড়বে।
তৃতীয়ত, বিদ্যুতের বিক্রি কমে গেলেও পিডিবিকে একক ক্রেতা হিসাবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে যেতে হবে।
প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার বিবেচনায় পিডিবিকে পৃথক চার্জ দিতে হয়। গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ আট হাজার ৭২২ কোটি টাকা দিতে হয়েছে পিডিবিকে।
চলমান লকডাউন পরিস্থিতির কারণে বিদ্যুৎখাতে যে ক্ষতি হচ্ছে তার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব বের করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।সোমবার বিদ্যুৎবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সে তিনি বলেন, উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় সামনে রাজস্ব ঘাটতি আসছে। সময়মত বিল পরিশোধ না হওয়ার কারণে বিতরণ সংস্থাগুলোতেও রাজস্ব ঘাটতি হবে। ভবিষ্যতের জন্য কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার আগে এর একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব বের করা প্রয়োজন।
“সেই হিসাব অনুযায়ী সরকার ও দাতা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। ইতোমধ্যে বিশ্ব ব্যাংক সহযোগিতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।”
পাওয়ার সেলের মহা পরিচালক এ বিষয়ে বলেন, বিদ্যুৎ খাত কী ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে তা বুঝতে একটি সমীক্ষা চলছে।
“এর ফলাফল হাতে আসতে এক মাসের মত সময় লেগে যাবে। এর ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করা হবে, যেটাকে বলা হয় বিসিপি বা বিজনেস কন্টিনিউটি প্ল্যান।”