লকডাউনে বায়ুদূষণ কম
করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় দেশে দেশে জারি করা লকডাউনে গাড়ি চলাচল ও কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় বিশ্বজুড়ে বায়ুদূষণ অভূতপূর্ব মাত্রায় কমেছে বলে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
বিশ্বের যে বড় বড় শহরগুলো বায়ুদূষণের তালিকায় নিচের অবস্থানে ছিল তিন সপ্তাহের লকডাউনে সেসব শহরের অবস্থা অনেকটা ভালো দেখা গেছে। কোনো কোনোটির প্রতি ঘনমিটার বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
করোনাভাইরাসে তুলনামূলক বেশি আক্রান্ত এবং কোভিড-১৯ মোকাবেলায় লকডাউন দিয়েছে এমন ১০টি বড় শহরকে নিয়ে বৈশ্বিক বায়ুমানের তথ্য রাখা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার এ গবেষণাটি করেছে বলে জানিয়েছে সিএনএন।
আইকিউএয়ারের গবেষকরা শহরগুলোর বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকর বস্তুকণা বা পিএম ২.৫ এর মাত্রার তুলনা করেছেন।
বাতাসে ভাসমান এ বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এককে। সাধারণত বস্তুকণাকে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস শ্রেণিতে ভাগ করে তার পরিমাপের ভিত্তিতে গবেষকরা ঝুঁকি নিরূপণ করেন।
এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলো নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের ফুসফুসে এবং সেখান থেকে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও রক্তেপ্রবাহে পৌঁছে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।
ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের মেরিন ড্রাইভ, দূরের ভবনগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
আইকিউএয়ারের গবেষকরা দেখেছেন, লকডাউনের কারণে ১০টি শহরের মধ্যে সাতটিতেই বাতাসে বায়ুমানের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। যেসব শহর আগে পিএম ২.৫ এর উচ্চ মাত্রার দূষণ দেখেছে, সেসব শহরেই বায়ুদূষণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা নিয়ে এ গবেষণায় থাকা শহরগুলোর মধ্যে ভারতের নয়াদিল্লি, মুম্বাই, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল, চীনের উহান, যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ইতালির রোম ও স্পেনের মাদ্রিদ আছে বলে জানিয়েছে সিএনএন।
গবেষকরা দেখেছেন, লকডাউনের কারণে চলতি বছরের ২৩ মার্চ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত নয়া দিল্লির বাতাসে পিএম ২.৫ মাত্রা ছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম।
গত কয়েক বছর ধরে ভারতের এ রাজধানী শহরকে প্রায়ই বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষে দেখা যেত।
কেবল নয়া দিল্লিই নয়, লকডাউনের কারণে দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইও বায়ুমানের উন্নতি দেখেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের ১৮ তারিখ পর্যন্ত পিএম ২.৫ এর মাত্রা ছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৪ শতাংশ কম।
বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণার বেশি উপস্থিতির কারণে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার বায়ুমানই ছিল সবচেয়ে খারাপ।
গত বছরের মার্চে দেশটি বায়ুদূষণকে ‘সামাজিক দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল।
ডিসেম্বরের শেষদিকে চীনের যে শহর থেকে প্রাণঘাতী নতুন করোনাভাইরাস আবির্ভূত হয়েছিল লকডাউনে সেই উহানের বায়ুদূষণের মাত্রায়ও অভূতপূর্ব হ্রাস দেখা গেছে।ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে চীনা কর্তৃপক্ষ এক কোটি ১০ লাখ বাসিন্দার এ শহরটিতেই প্রথম লকডাউন দিয়েছিল।
হুবেই প্রদেশের এ রাজধানীতে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত বায়ুদূষণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪ শতাংশ কম দেখা গেছে।
বায়ুদূষণ কমায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোতে আকাশ অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি পরিষ্কার দেখা গেছে।
৭ থেকে ২৬ মার্চ- এ ১৮ দিনেই লস এঞ্জেলসের বাতাসে আগের বছরের তুলনায় পিএম ২.৫ এর মাত্রা ৩১ শতাংশ কম পাওয়া গেছে।
লন্ডন, মাদ্রিদ ও রোমেও ২০১৯ সালের তুলনায় লকডাউনের দিনগুলোতে বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা ছিল কম।
আইকিউএয়ারের গবেষকদের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে ‘ধরিত্রী দিবসের’ ৫০তম বার্ষিকীতে। এ বছর দিবসটিতে জলবায়ু পরিবর্তনরোধে কার্যকর পদক্ষেপের ওপর আলোকপাত করারই লক্ষ্য ছিল।
বায়ুদূষণ বিশ্বজুড়েই জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম বড় হুমকি। প্রতিবছর এ দূষণের কারণে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যেসব গ্যাসের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেসব গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর মধ্য দিয়েই একদিকে পরিষ্কার আকাশ আর অন্যদিকে দূষণ সংক্রান্ত মৃত্যু কমানো সম্ভব।
আইকিউএয়ারের গবেষকরা বলছেন, কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব থামলে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির চাকা ফের সচল হলে বায়ুদূষণের মাত্রা আবার বেড়ে যাবে বলেই মনে করছেন তারা।
“এমন অনন্য সাধারণ পরিস্থিতির পর পরিবেশ এবং যে বাতাসে আমরা শ্বাস নিই, তার ওপর আমাদের সমাজগুলোর কর্মকাণ্ডের পরিবর্তন কেমন প্রভাব ফেলে তা দেখতে পাবো আমরা,” বলেছেন আইকিউএয়ারের বিপণন বিশেষজ্ঞ কেলসে দুসকা।