রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ‘১+১+২’ ফর্মুলা চীনা রাষ্ট্রদূতের
মিয়ানমার সরকারের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের ‘আস্থার ঘাটতি’ দূর করতে মোবাইল ফোনে সংযুক্তির নতুন ফর্মুলা সামনে এনেছেন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
এই প্রক্রিয়ার নাম তিনি দিয়েছেন ‘১+১+২’ আইডিয়া। এটা কীভাবে কাজ করবে সেই বিবরণ তিনি রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
গত সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে লি জিমিং বলেন, ”রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের তথাকথিত বিশ্বাসের ঘাটতি মোকাবেলায় ‘ওয়ান প্লাস ওয়ান প্লাস টু’ আইডিয়া নিয়ে এসেছি আমি।
”এক্ষেত্রে একটি রোহিঙ্গা পরিবার এমন একজনকে প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচন করবে, যে কি না মিয়ানমারে ফিরে যাবে। চীন তাদেরকে দুটি মোবাইল ফোন দেবে। একটি ওই প্রতিনিধির কাছে থাকবে, আরেকটি থাকবে কক্সবাজারে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে।”
চীনা দূত বলছেন, পরিবারের প্রতিনিধিরা মিয়ানমারে গিয়ে যা দেখবেন, তা জানাতে পারবেন শরণার্থী শিবিরে থাকা তার স্বজনদের।
“মিয়ানমারে গিয়ে তারা স্বচক্ষে পরিস্থিতি দেখবে, রাখাইনের পরিস্থিতি ভালো ও নিরাপদ কি-না তাৎক্ষণিকভাবে পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করবে। সেই আলোকে তারা দেখবে, সামনে আগানো যাবে কি-না।“
এই স্বেচ্ছাসেবক প্রতিনিধিদের নিরাপত্তা মিয়ানমার সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন চীনা রাষ্ট্রদূত।
রোববার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ পোস্ট আয়োজিত ‘রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের কৌশল সন্ধান’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছিলেন লি জিমিং।
সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে মিয়ানমারে ফেরার বিষয়ে ইতিবাচক বক্তব্য পাওয়ার কথা তিনি সেমিনারে তুলে ধরেন।
রোহিঙ্গা সঙ্কটে মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়ায় চীনের যে সমালোচনা, তার জবাব সেমিনারে দেন রাষ্ট্রদূত।
তিনি বলেন, “পৃথিবীর অনেক দেশে এমন কথা চালু আছে, চীন যা বলে মিয়ানমার সেই অনুযায়ী কাজ করে। এই ধরনের বিশ্বাস থেকে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে অর্থনৈতিক কারণে চীন বোধহয় সবসময় মিয়ানমারের পক্ষে থাকছে। এটা সম্পূর্ণ ভুল।
”মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ। কী করতে হবে সেটা তাদের বলার অধিকার চীনের নাই।”
মিয়ানমারের সব বৈদেশিক নীতি ‘সমতা ও পারস্পরিক সম্মানের’ উপর ভিত্তি করেই ঠিক হয় মন্তব্য করে রাষ্ট্রদূত বলেন, “আমি এবং ইয়াঙ্গুনে আমার সহকর্মী- আমরা কেবল বার্তা পৌঁছে দিই, সহায়তা করি, সাজেশন তৈরি করে দিই। আমরা কোনো দেশকে এমন কোনো কাজ করতে বাধ্য করি না, যেটা তারা করতে চায় না “
দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়ের ক্ষেত্রে আপস রফার সীমাটা কোথায়, এক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি কারা- ‘চীন তা জানে’ বলে মন্তব্য করেন লি জিমিং।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। এর মধ্যে সাড়ে সাত লাখই এসেছে ২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন শুরু হওয়ার পর।
মিয়ানমার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ায় দুই দফা চেষ্টা করেও রোহিঙ্গাদের কাউকে রাখাইনে ফেরত পাঠানো যায়নি।
রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নিতে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
রাষ্ট্রদূত বলেন, “কক্সবাজারের মানুষের ওপর আরও বেশি নজর দিতে হবে, কারণ তারাও ভুগছে; দ্বিতীয়ত অর্থ সহায়তার ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং এর যথাযথ তদারক করা, যাতে টাকাটা ঠিকমত রোহিঙ্গা এবং স্থানীয়দের জন্য খরচ হয়। তৃতীয়ত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ সংলাপ বজায় রাখা।”
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) পরিচালক স্টিভেন করলিস সেমিনারে বলেন, ”আমি আমার ত্রিশ বছরের জীবনে এমন অবর্ণনীয় শরাণার্থী শিবির দেখিনি, যেটা দেখেছি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে। বাধ্য হয়েই তারা সেখানে বসবাস করছে।
”আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের শতকরা ৯৭ জনই নিজেদের দেশে ফিরে যেতে চায়। তবে এর জন্য তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও চায়। আর তাদের এ নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন।”
বাংলাদেশ পোস্টের প্রধান সম্পাদক শরীফ শাহাব উদ্দিনের সভাপতিত্বে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
অন্যদের মধ্যে ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ, কানাডিয়ান হাই কমিশনের রাজনৈতিক উপদেষ্টা সাবিনা ইয়াসমিন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।