রোহিঙ্গাদের কারণে এইডস ঝুঁকিতে পড়েছে দেশ
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কারণে এইডস ঝুঁকিতে পড়েছে দেশ। এক বছরে ১১৫ জন রোহিঙ্গা ও ১০ বাংলাদেশির মধ্যে রোগটি শনাক্ত হয়েছে। দিন যতই গড়াচ্ছে শরণার্থী শিবিরগুলোতে এইডসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে এসব রোগী অবাধ চলাফেরা করায় এইডস ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। এর ফলে শুধু কক্সবাজারই নয়, সারাদেশে এইডসের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষেরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্য সচেতন না হলে এইচআইভি এইডস মহামারী রূপ নিতে পারে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
মাহবুব কামাল, কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ১১৫ জন রোহিঙ্গা ও কক্সবাজারের ১০ জন এইডসে আক্রান্ত হয়েছেন। আর গত ৭ বছরে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১০ জনে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ৬১২ জন। মোট আক্রান্তের মধ্যে ১১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে রোহিঙ্গা ৬১ জন।
rohingya camps-2২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ কক্সবাজারে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৮৫ জন, যা গড়ে প্রতিবছর ৯৭ জন এইডসে আক্রান্ত হন। চলতি বছর আরও ১২৫ জনসহ এই সময়ে মোট ৭১০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এনজিও ও কক্সবাজার সদর হাসপাতালের এইচআইভি ট্রিটমেন্ট সেন্টার এমন তথ্য প্রকাশ করেছে।
এইডসের এভাবে ছড়িয়ে পড়ায় তা ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই রোগের বিস্তার ভয়াবহ আকার ধারণ করায় চিন্তার ভাঁজ পড়ছে সবার মাঝে। এমন অবস্থায় কক্সবাজারের স্থানীয়রাও মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার মানুষ এইচআইভি এইডস রোগে আক্রান্ত। এই রোগে এ পর্যন্ত ১৫৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এইচআইভি এইডস নিয়ে কাজ করে এক এনজিও কর্মকর্তা ঢাকা মেইলের প্রতিবেদককে জানান, হয়তো আরও গভীরভাবে তথ্যানুসন্ধান করলে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ও এইচআইভি ভাইরাসের ফোকালপারসন ডা. আশিকুর রহমান বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকেই কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এইডস স্ক্যানিংয়ের কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয়। গত ৬ জুলাই পর্যন্ত ৭১০ জনের শরীরে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে। এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের একজনের শরীরেও এইচআইভির জীবাণু পাওয়া গেছে। এ রোগে ৬১ রোহিঙ্গাসহ ১১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এইডস আক্রান্ত কে, কোথায়, কোন অবস্থায় আছে তার সঠিক হিসাব সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কারও কাছে নেই।’
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সাবেক আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আবদুর রহমান শাহীন বলেন, ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। ভিন্ন রোগ নিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের শরীরে পরীক্ষায় ধরা পড়ছে এইচআইভি এইডস। এই রোগের বিস্তার রোধে ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান চলছে। তাছাড়াও মাঠ পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে উখিয়া ও টেকনাফে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার ১২টি টিম কাজ করছে।’
বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা বলছেন, কক্সবাজার এইডসের জন্য এখন চরম বিপজ্জনক এলাকা। রোহিঙ্গারা যে হারে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সে তুলনায় শনাক্ত করা হচ্ছে খুবই নগন্য। প্রকৃত অর্থে আক্রান্তের সংখ্যা কত তা এ মূহুর্তে বলা মুশকিল। এইচআইভি এইডসের জীবাণু বহনকারীর সংখ্যা যে আরও অনেক বেশি তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
শহরের হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস, রেস্ট হাউসে ১০/১২ হাজার রোহিঙ্গা যাতায়াত রয়েছে বলে জানান হোটেল ব্যবসায়ী নজির আহমদ। রোহিঙ্গা তরুণীরা দেশি-বিদেশি পর্যটক ও স্থানীয়দের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। অধিকাংশ রোহিঙ্গা তরুণী অশিক্ষিত হওয়ায় তারা অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হচ্ছেন। ফলে কক্সবাজার ছাড়াও সারাদেশে এইডস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবু মোহাম্মদ শামসুদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গা ছাড়াও পর্যটন শহর হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেশি টাকা আয়ের উদ্দেশ্যে যৌনকর্মীরা কক্সবাজারে আসেন, যা ভাইরাসটি বিস্তারের আরেকটি অন্যতম কারণ। প্রবাসীদের অনেকেই এইডস আক্রান্ত হয়ে দেশে আসছেন। তাদের কারণেও ছড়াচ্ছে ভাইরাসটি। এসব মিলে পরিস্থিতি দিন দিন আরও জটিল হচ্ছে।
ডা. শামসুদ্দিন আরও বলেন, অনেকে এইডস আক্রান্ত জেনেও জীবাণু বহন করছেন কিন্তু লোকলজ্জার কারণে প্রকাশ করছেন না। যে কারণে এক থেকে একাধিক মানুষের শরীরে ছড়াচ্ছে রোগটির জীবাণু। আবার যাদের দেহে ভাইরাস পাওয়া গেছে তারা চিকিৎসা নিতে গড়িমসি করছেন।’
কক্সবাজারের নারী নেত্রী নাজনীন সরওয়ার কাবেরী বলেন, কক্সবাজারসহ পুরো দেশজুড়ে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ায় তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের মেলামেশা হচ্ছে। এমনকি যৌন সম্পর্কেও জড়াচ্ছেন অনেকে। সেখান থেকে মূলত ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন হোটেল ও বাসাবাড়িতে যৌনকর্মে লিপ্ত হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। ইতিমধ্যে পেশাদার যৌনকর্মী ও খদ্দেরদের নিয়ে বেশ কয়েকটি কর্মশালা করেছেন একাধিক এনজিও সংস্থা। তারপরও থেমে নেই তাদের অনিরাপদ যৌনমিলন।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার মানুষ এইচআইভি এইডস রোগে আক্রান্ত। এই রোগে এ পর্যন্ত ১৫৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন মাহবুব কামাল বলেন, এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষেরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্য সচেতন না হলে এইচআইভি এইডস মহামারী রূপ নিতে পারে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।