রূপসায় চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশের রমরমা বাণিজ্য
দ. প্রতিবেদক
সাদা সোনা খ্যাত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিদ্রব্য চিংড়ি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার লোভে এই সাদা সোনা চিংড়ির ওজন বাড়াতে এতে অপদ্রব্য পুশ করে বাজারজাত করছেন। খুলনার পূর্ব রূপসা ও নগরীর নতুন বাজারে অবৈধ ভাবে চলছে চিংড়ি মাছে পুশের ব্যবসা। ফলে চিংড়ি রপ্তানির ব্যবসা আজ ধংসের দ্বারপ্রান্তে।
এ অঞ্চলের মাছ কোম্পানীর কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করলে নাম প্রকাশ না করে বলেন, এই চিংড়ি মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু এই অবৈধ পুশের কারণে বাইরের দেশ বাংলাদেশ হতে আর চিংড়ি নিতে চায় না। এমনকি বাইরের দেশ এই পুশ করা চিংড়ি ফেরত পাঠাতে পারে। তখন চিংড়ি ব্যবসা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। অসাধু চিংড়ি ব্যবসায়ীদের কারণে প্রতিদিন পূর্ব রূপসা ও নতুন বাজার মাছ ঘরগুলোতে এভাবে চিংড়ি মাছ পুশের ব্যবসা চলছে অহরহ।
খুলনার খুচরা থেকে শুরু করে পাইকারি বাজারে চলছে এসব চিংড়ির রমরমা বাণিজ্য। এ মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে শারীরিক বিভিন্ন রোগে আক্রান্তসহ ব্যাপক স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে বলে জনিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেক সময় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ভেজাল গলদা চিংড়ি বিক্রির অভিযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীকে জেল-জরিমানা করলেও কারাগার থেকে বেরিয়ে ফের এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন তারা।
র্যাব ও কোস্টগার্ড ও খুলনা মৎস্য অধিদপ্তরে অভিযান অব্যহত থাকার পরও প্রতিদিনই এভাবে চলছে পুষের কারবার। এক শ্রেণির উঠতি বয়সের যুবকেরা মাছ ধরা চাকরি করতে এসে সিলিঞ্জের মাধ্যমে সাগু, জেলি ও সুজি মিশিয়ে ওজন বাড়িয়ে থাকে। যত ওজন বাড়বে তত টাকা পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে মাছ ঘর মালিকদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। মাছ ঘরে অসাধু ব্যবসায়ী গভীর রাত পর্যন্ত এভাবে মাছে পুশ করে থাকে। এভাবে নোনা পানির সোনার ব্যবসাটি আজ ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে। চিংড়ি মাছে পুশ করার ফলে বিদেশে মাছের দাম কমে যায়। বাংলাদেশের চিংড়ি মাছের চাহিদ ইউরোপে বেশি ছিল। কিন্তু পুশের কারণে সেই চাহিদাও কমে যাচ্ছে। এভাবে বাংলাদেশে অনেক মাছ কোম্পানি আস্তে আস্তে লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সব মাছ কোম্পানিগুলো উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
কিন্তু কালের বিবর্তনে চিংড়ি এখন অভিজাত ব্যক্তির প্লেটে সৌখিন খাবারের রূপ নিয়েছে। রেস্টুরেন্ট ও হোটেলগুলোর দামি খাবারের তালিকায় চলে গেছে। আর এই সুযোগে চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করে ওজন বাড়াচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। দেশের ৭০ ভাগ চিংড়ি খুলনাঞ্চল থেকে রপ্তানি হলেও দিন দিন নানা সঙ্কটে এর রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। পুশকৃত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করায় বিদেশি ক্রেতা বাংলাদেশি চিংড়ির ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে। যা রপ্তানিতে প্রভাব পড়ছে। বিদেশের বাজার হারিয়ে এই চিংড়ি এখন কম দামে দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। স্বাদে ভরপুর চিংড়ি খাওয়ার আশায় এসব পুশকৃত চিংড়ি বাজার থেকে অনেকেই না বুঝে কিনছেন। আর এসব চিংড়ি খেয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন।
অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় চিংড়ির দেহে সিরিঞ্জ এর মাধ্যমে ফিটকিরির পানি, ভাতের মাড়, সাগু, এরারুট, লোহা বা সীসার গুলি, মার্বেল, ম্যাজিক বল, জেলিসহ বিভিন্ন ধরনের পদার্থ মেশাচ্ছেন। এর মধ্যে জেলি, সাগু, পাউডার ও সাদা লোহা জাতীয় দ্রব্য গলদা চিংড়িতে বেশি পুশ করা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে ওজন বাড়াতে চিংড়ি পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়।
পুশকৃত চিংড়ি বোঝার উপায় সম্পর্কে মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ খুলনার উপ-পরিচালক বলেন, স্বাভাবিক চিংড়ির হাত-পা কুঁকড়ে থাকে, কিন্তু পুশকৃত চিংড়ির হাত-পা ছড়িয়ে থাকে। বাইরে থেকে পুশকৃত চিংড়ি দেখতে একটু মোটা হয়, চিংড়ির গায়ে একটা টনটন ভাব থাকে। এছাড়া চিংড়ির মাথা ভেঙ্গে দেহের অংশে চাপ দিলে পুশকৃত চিংড়ি থেকে পানি বেরিয়ে আসে, জেলি পুশ করা চিংড়ি থেকে একটা পিচ্ছিল পদার্থ বেরিয়ে আসে। আমরা সাধারণত যেটা করি, চিংড়ির পেছনের নালীর বরাবর কলম বা চাবি দিয়ে কেটে ফেলি, তারপর দেহের অংশে চাপ দিলে পানি পুশ বা জেলি পুশ যাই থাকে সেটা বেরিয়ে আসে। পানি পুশ হলে পিচ্ছিল পানি বেড়িয়ে আসে। জেলি পুশ হলে পিচ্ছিল পদার্থ বের হয়। আজকাল আগার জাতীয় জেলি পুশে ব্যবহার করা হচ্ছে। চিংড়িতে আগার পুশ করলে সেটা ভেতরে গিয়ে চিংড়ির মাংসের মতো শক্ত হয়ে থাকে। মাথা ভেঙ্গে দেহের অংশে চাপ দিলে একটা শক্ত সুতার মতো পদার্থ বেরিয়ে আসে।
জনসাধারণের প্রতি পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, জনসাধারণের উচিত চিংড়ি কিনতে গেলে মাথা ভেঙ্গে দেখা। চিংড়ির মাথা ভেঙ্গে মাথা ও দেহে উভয় অংশ চাপ দিলে পানিপুশকৃত চিংড়ি থেকে পানি বেরিয়ে আসবে, জেলিপুশ করা চিংড়ি থেকে একটা পিচ্ছিল পদার্থ বেরিয়ে আসবে। যা হাতে নিলে পিচ্ছিল মনে হবে। শক্ত কিছু পুশ হলে সুতার মতো বেড়িয়ে আসবে।
দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ জে এফ জয়