November 25, 2024
জাতীয়লেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

‘রিজার্ভ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক’

করোনা মহামারির মধ্যেই রিজার্ভে রেকর্ড গড়েছিল বাংলাদেশ। মহামারি কাটতে না কাটতেই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সংকটে পড়লো গোটা বিশ্ব। যার আঁচ এসে পড়লো আমাদের রিজার্ভেও। সরকার যে রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কিত, তা সংশ্লিষ্টদের কথাতেও স্পষ্ট। রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা করছেন প্রধানমন্ত্রীও।

সরকার রিজার্ভ কমার জন্য বৈশ্বিক পরিস্থিতি আর উন্নয়ন ব্যয়কে দায়ী করলেও অন্য আলোচনাও আছে এই ইস্যুতে।

‘সংকট হতে পারে, তা নানা সূচকেই প্রকাশ পাচ্ছিল। রিজার্ভ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। আমরা রিজার্ভ, রেমিটেন্সের মোহ কেটে যাবে বলে উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কথা আমলে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়নি।’

রিজার্ভ কমে আসা, সংকট উত্তরণে করণীয় প্রভৃতি প্রসঙ্গ নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। দু’জনই অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম তার আলোচনায় বলেন, ‘আজকের যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তার জন্য আমরা আগে থেকেই সাবধান করে বক্তব্য দিয়ে আসছি। সংকট হতে পারে, তা নানা সূচকেই প্রকাশ পাচ্ছিল। রিজার্ভ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। আমরা রিজার্ভ, রেমিট্যান্সের মোহ কেটে যাবে বলে উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কথা আমলে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়নি। বরং সরকার সমালোচনা গ্রহণ করতেও নারাজ।’

‘৫০-এর কোটা থেকে রিজার্ভ এখন ৩৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে এবং এই নেমে আসার হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যদিও আইএমএফ বলছে বাংলাদেশ রিজার্ভ কাউন্টিংয়ে ইন্টারন্যাশনাল নীতি ফলো করে না। এই নীতি ফলো করলে রিজার্ভ আরও কমে আসবে।’

সংকট উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী? জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বাংলাদেশের রিজার্ভ যে কয়টি উইংসের ওপর দাঁড়িয়ে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এই রেমিট্যান্স বাড়ানো জরুরি। এর জন্য কী করণীয় সরকারের তা ভাবতে হবে। আরও প্রণোদনা দেবে নাকি বিদেশে শ্রমবাজার বাড়াবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।’

‘রপ্তানি আয় বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। রপ্তানি আয় কেন কমে যাচ্ছে, তা গুরুত্ব দিতে হবে। আর বহুমুখী রপ্তানির কথা আমরা বারবার বলে আসছি। আমরা পোশাকখাতের বাইরে আর কোনো খাতে তেমন গুরুত্ব দিতে পারিনি। অথচ, আমরাদের বহু খাত রয়েছে, যা দিয়ে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করা সম্ভব। উৎপাদমুখী উন্নয়ন করতে হবে।’

‘রপ্তানি আয় বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। রপ্তানি আয় কেন কমে যাচ্ছে, তা গুরুত্ব দিতে হবে। আর বহুমুখী রপ্তানির কথা আমরা বারবার বলে আসছি। আমরা পোশাকখাতের বাইরে আর কোনো খাতে তেমন গুরুত্ব দিতে পারিনি। অথচ, আমাদের বহু খাত রয়েছে, যা দিয়ে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করা সম্ভব। উৎপাদমুখী উন্নয়ন করতে হবে।’

‘আমরা প্রচুর জিনিস আমদানি করে আসছি। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সবই আমদানি করি। অপ্রয়োজনীয় আমদানি ঠেকাতে হবে। বিলাসদ্রব্য আমদানি একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে। আমদানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ বাইরে চলে যায়। মূলত বাইরে যে অর্থপাচার হয়ে আসছে, তা আমদানির অতি ব্যয়ের মাধ্যমেই।’

সরকার তো বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে দায়ী করছে। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও সংকটের জন্য দায়ী। প্রধানমন্ত্রী অন্তত তাই বলতে চাইছেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি অসলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ধরে কোনো মন্তব্য করি না। বৈশ্বিক পরিস্থিতি কিছুটা দায়ী তো বটেই। বিশ্বজুড়ে উৎপাদন কমে গেছে। আমদানিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে অতিরিক্ত টাকা বাইরে যাবেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভাব ফেলছে সব ক্ষেত্রেই। যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তা ঠিক করতে একটু সময় লাগতে পারে। রেমিট্যান্স বাড়ানো, রপ্তানি আয় যদি বাড়ে তাহলে সংকট কিছুটা কমে যাবে। সবার আগে সুশাসন দরকার।’

প্রায় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এই বিশ্লেষক মনে করেন, ‘এত দ্রুত রিজার্ভ কমে যাওয়া অবশ্যই চিন্তার বিষয়। চলতি হিসাবের যে ভারসাম্য, তা অনেক নেগেটিভ। দেশের ইতিহাসে রিজার্ভ খারাপ অবস্থায় আছে। এর প্রভাব এরই মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। টাকার মান ভয়াবহভাবে কমে যাচ্ছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। সার্বিক অবস্থা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। মানুষ তো আসলে ভালো নেই। জীবনের মান কমে যাচ্ছে। ’

‘প্রবাসে যাচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক। দক্ষ করে পাঠাতে পারলে দ্বিগুণ আয় করতে পারতো। অন্য দেশের একজন শ্রমিক যে আয় করে আমাদের তিনজন শ্রমিক সে আয় করে। দক্ষতার প্রশ্নে এমন বৈষম্য হয়ে আসছে। সরকার তো এতদিনে এটি বুঝতে পারার কথা। কারণ রেমিটেন্সের উপরেই দেশের অর্থনীতি।’

সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো ২০২৪ সাল থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কিছু কিছু ঋণ আছে স্বল্পমেয়াদি। সময় এসে গেছে ঋণ শোধের। তার মানে সামনে আরও চাপ বাড়বে। আবার ঋণ সময়মতো শোধ করতে না পারলে, সুদ আরও বাড়বে।’

‘সবচেয়ে বিপদে আছে সাধারণ মানুষ। মধ্যবিত্তরা আসলে কোথাও যেতে পারছে না। তাদের সামনে কোনো পথ নেই। করোনার পর পরিস্থিতি উতরানোর কথা থাকলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরও খারাপ করে দিচ্ছে। এরপর জলবায়ুর পরিবর্তন সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে সিত্রাংয়ের তাণ্ডব দক্ষিণের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। চরম অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে সর্বত্রই। বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে কঠিন সময় পার করছে।’

সংকট উত্তরণের উপায় বাতলিয়ে বলেন, ‘আমাদের পুরোনো কৌশল বাদ দিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা উন্নয়ন বলতে শুধুই প্রবৃদ্ধি বুঝে আসছি। এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। প্রবৃদ্ধি সত্যিকার উন্নয়নের মাপকাঠি নয়, তা এখন বুঝতে পারার কথা। বৈষম্য বাড়ছে। গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বেকার বাড়ছে। মানুষ এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। যাদের সঞ্চয় নেই তারা রাস্তায় বসে যাচ্ছে। ঋণ করছে। মানসম্পন্ন জীবন গড়তে চ্যালেঞ্জ তো বাড়িয়ে দিয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো কিছুটা ভালো ছিল। এখন সেটাও ভেঙে যাচ্ছে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট বাড়ছে।’

নতুন কৌশল কী হতে পারে? জবাবে বলেন, ‘আপনাকে কথিত উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এড়িয়ে চলতে হবে। সার্বিক উন্নয়নে আপনাকে মনোযোগ দিতে হবে। বিনিয়োগের নানা ধরন আছে। ঢাকায় ফ্লাইওভার করলে এখানে কারা সুবিধা পায় আর গ্রামের রাস্তার উন্নয়ন করলে কারা সুবিধা পায় এটি আপনাকে তুলনা করে ভাবতে হবে। ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প, কৃষিশিল্পে সেই অর্থে বিনিয়োগ করেনি সরকার। এগুলো ব্যক্তিপর্যায়ে উন্নয়ন ঘটেছে। খাদ্যের ওপর যে চ্যালেঞ্জ, তা কৃষিই সামাল দিচ্ছে। রাষ্ট্রের যা করার, তা করেনি। এখানে জিডিপি কম হতে পারে, কিন্তু এখানে ৫০ শতাংশ মানুষ নির্ভর করে।’

সরকার রপ্তানির বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এটির ওপর সব অর্থনীতিবিদ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। অথচ, শুধু তৈরিপোশাক নিয়েই সরকার ব্যস্ত। যত সুবিধা গার্মেন্ট মালিকদের, যত প্রণোদনা গার্মেন্টে। এখানেও দরকার, তবে সেটা শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে। রাষ্ট্রের সুবিধা মালিক কতটুকু পেলে আর শ্রমিক কতটুকু পাবে তা ভাবতে হবে। যারা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের কথা ভাবেন আর যারা শ্রমিক তাদের ভাগ্যের কথা ভাবেন। পরিষ্কার ধারণা নিতে পারবেন।’

‘আমরা জনসম্পদ উন্নয়ন বা দক্ষতার কথা বলে আসছি। তাতে কী কাজ হচ্ছে। প্রবাসে যাচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক। দক্ষ করে পাঠাতে পারলে দ্বিগুণ আয় করতে পারতো। অন্য দেশের একজন শ্রমিক যে আয় করে আমাদের তিনজন শ্রমিক সে আয় করে। দক্ষতার প্রশ্নে এমন বৈষম্য হয়ে আসছে। সরকার তো এতদিনে এটি বুঝতে পারার কথা। কারণ রেমিট্যান্সের উপরেই দেশের অর্থনীতি।’

শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার ওপর সবচেয়ে নজর রাখার কথা। তা হয়নি পঞ্চাশ বছরেও। মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা না থাকলে কাজ করবে কীভাবে, কে বিনিয়োগ করবে? এরপর সুশাসন প্রশ্ন সামনে আসে। জবাবদিহি নেই। এটি কোথাও নেই। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে। ব্যাংক-বিমা, বাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান কেউ আর জবাব দেওয়ার তোয়াক্কা করে না। শেয়ারবাজার নিয়ে যা হলো, তার কোনো বিচার হয় না। আমরা দেখছি, অর্থপাচারের নানা তথ্য। সরকার তা আমলেও নেয় না, স্বীকারও করে না’ যোগ করেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

জাগোনিউজ২৪ থেকে

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *