রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সাত বছর আজ
সাভারের রানা প্লাজা ধস বাংলাদেশ তো বটেই গোটা দেশ বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়। দেশের ইতিহাসে কঠিন এ ট্র্যাজেডি ঘটে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। এ ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন। এরই মধ্যে সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনায় বিভিন্নভাবে দায়ীদের বিচারে নেই কোনো অগ্রগতি।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এ পর্যন্ত ভবনের মালিক রানা, তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্ন জনের নামে পাঁচটি মামলা হয়।
এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক একটি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিনটি মামলা দায়ের করে।
সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন সাবমিশন মামলায় রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়েছে ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট। এ মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এদিকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন আদালত।
এছাড়া ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আরেকটি মামলা চলমান আছে।
দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বাংলানিউজকে বলেন, মামলাটি বন্ধের আগে বদলি হয়ে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে এসেছে। আশা করছি শিগগিরই এ মামলার বিচারকাজ শুরু হবে।
দুদকের মামলায় বিচার হলেও ভবন ধসের ঘটনায় মূল মামলার বিচারে অগ্রগতি নেই। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’ মামলা করেন।
২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তবে অভিযোগপত্রে রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এরপর প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
জানা যায়, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের পক্ষে মামলাটি হাইকোর্টে স্থগিত থাকায় পুরো সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া স্থগিত আছে।
রানা প্লাজা ধস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। বাকি আসামিদের মধ্যে জামিনে আছেন ৩২ জন, পলাতক ছয়জন এবং মারা গেছেন দুইজন।
সোহেল রানার আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, রানার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মূল মামলার অভিযোগ গঠন হয় চার বছর আগে। ঘটনার পরপরই রানাকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি, তাকে জামিনও দেওয়া হয়নি।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি খোন্দকার আব্দুল মান্নান বলেন, হাইকোর্ট এ মামলার অভিযুক্ত ৮ আসামির কার্যক্রম স্থগিত করেছিল। ছয় জনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। বাকি দুজনেরটা দ্রুতই প্রত্যাহার হবে বলে আশা করছি। এরপরই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে বলে আমরা আশা করছি।
রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওইদিন সাভার থানায় মামলাটি করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
অভিযোগ গঠনের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। সেসব রিভিশন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন আসামির মামলার কার্যক্রম স্থগিত আছে। তাই এ মামলায়ও সাক্ষ্যগ্রহণ স্থগিত আছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুলের আশা শিগগিরই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা ভবন। ওই ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
হত্যা মামলায় সিআইডির অভিযোগপত্রে ঘটনার বিবরণীতে এসেছে, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় সাভারের রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। খবর পেয়ে বিজিএমইএর কর্মকর্তারা রানা প্লাজা ভবনে আসেন। গার্মেন্টস মালিকদের পরামর্শ দেন, বুয়েটের ভবন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে।
কিন্তু পাঁচ গার্মেন্টস মালিক এবং তাদের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে পরদিন ২৪ এপ্রিল শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। এর সঙ্গে যোগ দিয়ে সোহেল রানা বলেন, ‘আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না।’
বাণিজ্যিক এ ভবনে পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। এসব কারখানায় বসানো হয় বৈদ্যুতিক ভারী জেনারেটর, ভারী সুইং মেশিন। রানা প্লাজা ধসের আগের দিন ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল দেখা দেয়। কিন্তু মালিকপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে পরদিন পাঁচটি পোশাক কারখানা চালু করে। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় রানা প্লাজায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন একসঙ্গে পোশাক কারখানাগুলো তিনটি জেনারেটর চালু করে। ঠিক তখনই রানা প্লাজা ভবন বিকট শব্দ করে ধসে পড়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।