November 24, 2024
জাতীয়লেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

রাত পোহালেই ভোটের লড়াই

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হতে আর বাকি কয়েক ঘণ্টা। আজ রোববার (৭ জানুয়ারি) সকাল ৮টা থেকে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন ভোটাররা। বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীন চলবে এই ভোটগ্রহণ। প্রার্থীরাও মুখিয়ে আছেন এই সময়ে। সবারই প্রত্যাশা বিজয়ের। যদিও শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনা জোটের পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা। তবে, ভোটের মাঠে নেই বিএনপি ও তাদের সমমনারা। এমন এক নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশে দেখা গেছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, মিলেছে সহিংসতার তথ্য, অনেকে সরে গেছেন নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে, আবার চলেছে হত্যাকাণ্ডও। এরইমধ্যে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতির কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যদিও এই নির্বাচনকে অনেকে বলেছেন ‘একতরফা’।

এবারের নির্বাচনে সারা দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে ২৯৯টি আসনে। নওগাঁ-২ আসনের স্বতন্ত্রপ্রার্থী আমিনুল হকের মৃত্যুতে ওই আসনের নির্বাচন বাতিল করেছে ইসি। ফলে ২৮টি রাজনৈতিক দলের এক হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনা জোটের পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা।

গত ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিল অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে প্রস্তুতি শুরু করে। একইসঙ্গে স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা নেন প্রস্তুতি। পরে ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা শেষ হয় ৩০ নভেম্বর। এরপর যাচাই-বাছাই হয় ১ ডিসেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর। এই যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়া অনেক প্রার্থী যান হাইকোর্টে। আবার হাইকোর্টে প্রার্থিতা ফিরে না পেয়ে অনেকে দ্বারস্থ হন আপিল বিভাগে। সব মিলিয়ে আদলতের রায়ে অনেকে ফেরেন নির্বাচনি মাঠে।

প্রচারে প্রার্থীরা, বিরোধিতায় অন্যরা

প্রতীক পাওয়ার পরপরই প্রার্থীরা শুরু করেন নির্বাচনি প্রচার। ২০ ডিসেম্বর সিলেটে হজরত শাহজাল (র.)-এর মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচারে নামেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অন্যদিকে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ও দলীয় সররকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করেছে। পাশাপাশি দেশবাসীকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে তারা। তাদের ডাকে গতকাল শনিবার (৬ জানুয়ারি) থেকে চলছে টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতাল। ভোট বর্জনের ডাকও দিয়েছে দলটি। ভোটের দিন গণকারফিউয়ের কথা বলেছে ১২ দলীয় জোট। যদিও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

আন্তর্জাতিক তৎপরতা

সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিনয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশের ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও আন্দোলনরত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করে দুই দলকে সমঝোতায় আনারও চেষ্টা করেন।

বিএনপির অবস্থান

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে বিএনপি গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে সমাবেশের আয়োজন করে বিপুল নেতাকর্মীর সমাবেশ ঘটায়। ওই সমাবেশ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বিএনপির। এরপর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেপ্তার হতে দেখা যায়। দলটির অভিযোগ, বিএনপির ২০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে ২৮ অক্টোবরের পর গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়—আসামি ছাড়া কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি তারা।

ভোটার, কেন্দ্র, প্রার্থীর সংখ্যা

নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি সংসদীয় আসনে এক হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইসির নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এ নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে রয়েছেন ৪৩৬ জন।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৫ জন, জাতীয় পার্টির ২৬৪, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ১৩৫ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৬৬ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১৩ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ জন প্রার্থী রয়েছেন।

এই নির্বাচনে ২৯৯ সংসদীয় আসনে মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ২৪টি। এসব কেন্দ্রে ভোটকক্ষ দুই লাখ ৬০ হাজার ৮৫৮টি।

সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৩ লাখ ৩৩ হাজার ১৫৭ জন। যার মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ছয় কোটি ৫ লাখ ৯২ হাজার ১৬৯ ও নারী ভোটারের সংখ্যা পাঁচ কোটি ৮৭ লাখ ৪০ হাজার ১৪০। এ ছাড়া সারা দেশে এবার তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার আছেন ৮৪৮ জন।

কেন্দ্রে ব্যালট যাবে আজ সকালে

আজ সকালে কেন্দ্রে-কেন্দ্রে পাঠানো হবে ব্যালট পেপার। শুধু দুর্গম অঞ্চলের দুই হাজার ৯৬৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পাঠানো হবে ভোটের আগের দিন। যদিও অন্যান্য নির্বাচনি সরঞ্জাম পৌঁছে গেছে।

২২ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে ২২ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন করেছে কমিশন। এই মনিটরিং সেলের নেতৃত্ব দেবেন আইডিএ প্রকল্প-২ এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সায়েম। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, মনিটরিং সেল শনিবার সকাল ৮টা থেকে ৯ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত মোট ৭২ ঘণ্টা পরিচালনা করা হবে। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মাঠপর্যায়ে যথাসম্ভব যাচাই-বাছাই করা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে অবহিতকরণ ও জরুরি প্রয়োজনে বিশেষ প্রতিবেদন পাঠাবেন।

সহিংসতা ঠেকাতে প্রস্তুত পুলিশ

নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব ধরনের অরাজকতা থামাতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। নির্বাচনি মাঠকে ঘিরে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সোচ্চার তারা।

সাড়ে সাত লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য

নির্বাচনে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ লাখ ১৪ হাজার ২৮৮ জন আনসার সদস্য। এ ছাড়া ৬২ জেলায় সেনাবাহিনীর সদস্যরয়েছে ৩৮ হাজার ১৫৪ জন এবং ভোলা ও কক্সবাজার জেলাসহ মোট ১৯টি জেলায় নৌবাহিনীর সদস্য রয়েছে দুই হাজার ৮২৭ জন। বাকীদের মধ্যে রয়েছে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ড। ইতিমধ্যেই গত ৩ জানুয়ারি থেকে ভোটের মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট আট দিন মাঠে থাকবেন তারা। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে আগামী ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ সময় পর্যন্ত লাইসেন্সধারীরাও আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে পারবে না।

প্রায় তিন হাজার জুডিশয়াল-এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আট বিভাগে দুই হাজারেরও বেশি এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত রয়েছেন। বিভিন্ন অপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে গত শুক্রবার থেকে মাঠে নেমেছেন আরও ৬৫৩ জন বিচারিক হাকিম। বিচারিক হাকিমরা ভোটের আগে-পরে পাঁচদিন দায়িত্ব পালন করবেন। সবমিলিয়ে প্রায় তিন হাজার জুডিশিয়াল ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। এর আগে সারা দেশে ৩০০ আসনের জন্য ৩০০টি নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। তারা বিভিন্ন অপরাধে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের রেকর্ড সংখ্যাক সোকজ, তলব ও জরিমানা করেন। এ ছাড়া এসব কমিটির সুপারিশে নিয়মিত আদালতে অন্তত অর্ধশতাধিক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত দিয়েছে।

১৮৬ বিদেশিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি

নির্বাচন দেখার জন্য যে বিদেশিরা আবেদন জানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ১৮৬ জন পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের অনুমোদন দিয়েছে ইসি। তাদের মধ্যে ১২৭ জন পর্যবেক্ষক আর ৫৯ জন বিভিন্ন সংবাদকর্মী। এ ছাড়া নির্বাচন দেখতে দেশি ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দিয়েছে ইসি। তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ৪০টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ৫১৭ জন এবং স্থানীয়ভাবে ৮৪টি পর্যবেক্ষণ সংস্থার ২০ হাজার ২৫৬ জন ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন।

যানচলাচলে নিষেধাজ্ঞা-নির্দেশনা

নির্বাচন উপলক্ষে ৭২ ঘণ্টা মোটরসাইকেল চলাচলের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ সময় কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসনের সদস্য ও অনুমোদিত পর্যবেক্ষক, জরুরি সেবার যানবাহন, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অভিন্ন কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন (মোটরসাইকেলসহ), দূরপাল্লার যানবাহন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে। সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, জাতীয় মহাসড়ক, প্রধান আন্তজেলা রুট, মহাসড়ক এবং প্রধান মহাসড়কের সংযোগ সড়কের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ শিথিল থাকবে।

শেয়ার করুন: