November 24, 2024
আন্তর্জাতিকলেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

রয়টার্সের বিশ্লেষণ: মধ্যপ্রাচ্যের নেতা হতে চান সৌদি যুবরাজ

সুতো কেটে যাওয়া সময় বলছে সৌদি আরব আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটা আর আগের মতো ঘনিষ্ঠতায় নেই। উল্টো, দিনকে দিন বাড়ছে রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের বৈরিতা। আর সেই বৈরিতার নেপথ্য কারণ মধ্যপ্রাচ্যে একক আধিপত্য বিস্তার করতে চায় সৌদি আরব। যার পেছনের নায়ক সৌদি যুবরাজ (ক্রাউন প্রিন্স) মোহাম্মদ বিন সালমান।

তিনি ক্রাউন প্রিন্সের আসনটা নিজের করে নেওয়ার পরই ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে সৌদি। তার বিরুদ্ধে যেমন ইসরায়েল ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার অভিযোগ আছে, তেমন ২০১৮ সালে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার কলকাঠি নাড়ার অভিযোগও আছে।সম্প্রতি তেল উৎপাদন কমানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদির বৈরিতার খবর প্রকাশ্যে এসেছে। একের পর এক মার্কিন হুঁশিয়ারির পরও নিজেদের অবস্থান থেকে নড়েনি মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বাধীন সৌদি প্রশাসন। এবার সেই বৈরিতার পালে নতুন হাওয়া দিচ্ছে চীনের প্রেসিডেন্ট শিজিনপিংয়ের সৌদি সফর।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান চলতি সপ্তাহে রিয়াদে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে স্বাগত জানাবেন। আর জিনপিংয়ের সফর দিয়েই পশ্চিমা মিত্রদের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে মেরুকৃত বিশ্বে রিয়াদ নিজেদের অবস্থান জানান দিতে চাইছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছে, নিজের শক্তির জানান দিতে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের একটি সম্মেলনও আয়োজন করছেন যুবরাজ। চীন-আরব সম্মেলনের নামের এই আয়োজনে চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

ইউরেশিয়া গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রধান আয়হাম কামেল বলেন, ‘কৌশলগত হিসাব করে কাজ করছে সৌদি আরব। তারা ভাবছে চীনকে জায়গা দিতে হবে। কারণ অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে চীনকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই।’

বিশ্লেষকদের মতে, আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখনও অংশীদার। কিন্তু এরপরও সৌদি আরব এমন একটি পররাষ্ট্রনীতির দিকে হাঁটছে যাতে করে জাতীয় অর্থনীতি রূপান্তর করা যায়। এমন সময় এই পথে হাঁটছে সৌদি আরব যখন বিশ্ব তেলজাত পণ্য থেকে দূরে সরতে চাইছে, যা সৌদি আরবের প্রাণশক্তি।

কামেল বলেন, ‘চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে। এতে মার্কিন-সৌদি সম্পর্কে আরও ফাটল ধরতে পারে। তবে যুবরাজ নিশ্চিতভাবে এটিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।’

এমন সময় চীনা প্রেসিডেন্ট সৌদি আরব সফর করবেন যখন মার্কিন-সৌদি সম্পর্ক খুব নাজুক, বিশ্বের জ্বালানি বাজারে অনিশ্চয়তা এবং রুশ তেলের মূল্য বেঁধে দিয়েছে পশ্চিমারা। আর মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগের বিষয়তো রয়েছেই।

যদিও জিনপিংয়ের এই সফরের এজেন্ডা বা আলোচ্যসূচি কী সে নিয়ে কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য করেনি সৌদি আরব।

সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে মার্কিন সমালোচনায় বিরক্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন যুবরাজ। মার্চ মাসে আটলান্টিক সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাকে ভুল বুঝেছেন কিনা, তা নিয়ে ভাবছেন না তিনি। বাইডেনের উচিত আমেরিকার স্বার্থে মনোযোগ দেওয়া।

সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এসপিএ-তে ওই মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যুবরাজকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে চায় রিয়াদ। কিন্তু চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের স্বার্থ, বিনিয়োগ কমাতে পারে রিয়াদ।

বেইজিংয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করছে রিয়াদ। চীনের শীর্ষ তেল সরবরাহকারী দেশ সৌদি আরব। যদিও ওপেকপ্লাসের তেল উৎপাদনকারী রাশিয়া সস্তায় তেল দিয়ে চীনের বাজারে নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে।

বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের বদলে চীনা মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহারের পক্ষে ওকালতি করে আসছে বেইজিং। রিয়াদও এর আগে হুমকি দিয়েছিল তেল বাণিজ্যের কিছু ক্ষেত্রে ডলার বাদ দেওয়ার বিষয়ে।

মানবাধিকার ও ইয়েমেনে যুদ্ধ নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক টানাপড়েনে রয়েছে। এটি আরও বেড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ওপেকপ্লাসের তেল উৎপাদনের নীতির কারণে।

মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিকরা বলছেন, ২০১৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন জমকালো অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন, চীনা প্রেসিডেন্টের জন্য তেমন আয়োজন থাকতে পারে। বিপরীতে জুলাই মাসে বাইডেনের সৌদি আরব সফর দুই দেশের সম্পর্কের ফাটল আরও বাড়িয়েছিল।

বিমানবন্দরে ট্রাম্পকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন বাদশাহ সালমান। সফরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের মার্কিন অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি হয়েছিল। খাশোগি হত্যায় রিয়াদকে ‘একঘরে’ রাষ্ট্রে পরিণত করার হুমকি দেওয়া বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন শুধু যুবরাজ। হ্যান্ডশেকের বদলে তারা দুজন ফিস্ট বাম্প করেছিলেন।

কূটনীতিকরা বলছেন, চীনা প্রতিনিধিদল সৌদি আরব এবং অপর আরব দেশের সঙ্গে ডজন খানেক চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে। জ্বালানি, নিরাপত্তা ও বিনিয়োগ খাতে এসব চুক্তি হবে।

সৌদি আরব ও দেশটির উপসাগরীয় মিত্ররা বলে আসছে, তারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ নিশ্চিত করতে অংশীদারদের মধ্যে বৈচিত্র আনা অব্যাহত রাখবে। যদিও রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে এই অঞ্চলের সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহ রয়েছে।

আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো জনাথন ফুল্টন বলছেন, যুবরাজ চাইছেন বিশ্বের পরাশক্তিদের কাছে যে সৌদি আরবের গুরুত্ব রয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের কাছে তুলে ধরতে। হয়ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিতও দিতে চাইছেন। কিন্তু তিনি বেশি ভাবছেন সৌদি আরবের মানুষ কী ভাবছে।

রিয়াদভিত্তিক গাল্ফ রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান ও সৌদি বিশ্লেষক আব্দুলআজিজ সাগের বলেছেন, আরব দেশগুলো পশ্চিমা মিত্রদের বলতে চায় যে, আমাদের বিকল্প রয়েছে এবং তাদের সম্পর্ক মূলত অর্থনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে রচিত।

ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য কর্মসূচির পরিচালক জন অল্টারম্যান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু প্রকৃত সম্পর্ক তুলনা করার মতো নয়।

সূত্র: রয়টার্স

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *