রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কা
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
রপ্তানি আয় কমছেই। পণ্য রপ্তানিতে বড় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতি মাসেই কমছে এই আয়। অক্টোবর মাসে ৩০৭ কোটি ৩২ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ।
আর চলতি অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ শতাংশের মতো। লক্ষ্যমাত্রা থেকে কম ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। সার্বিক পরিস্থিতিকে ‘খুবই খারাপ’ উলেখ করে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক আরও ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, গেলো অক্টোবর মাসের ১ থেকে ২৮ অক্টোবর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ২২ শতাংশ। অথচ গত বছরের এই ২৮ দিনে ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এ নাজুক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য খুব শিগগিরই রপ্তানিকারকদের নিয়ে একটি বড় বৈঠক করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন রুবানা হক।
আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার মান কমাতে বলেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। সুখবর নিয়ে অর্থবছর শুরু হলেও দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেই ধাক্কা খায় রপ্তানি আয়। প্রথম মাস জুলাইয়ে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল।
কিন্তু আগস্ট মাসে গত বছরের আগস্টের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ আয় কম আসে। সেপ্টেম্বরে কমে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) মঙ্গলবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, অক্টোবর মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ ৩০৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার আয় করেছে। রপ্তানির এই পরিমাণ গত বছরের একই মাসের তুলনায় সাড়ে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম প্রায় ১২ শতাংশ।
গত বছর অক্টোবরে ৩৭১ কোটি ১১ লাখ ডলারের পন্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ।এবার অক্টোবরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৪৮কোটি ১০ লাখ ডলার। আর চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছে এক হাজার ২৭২ কোটি ১২ লাখ (১২.৭২ বিলিয়ন) ডলার।
এই আয়ের ৮৫ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এর মধ্যে এক হাজার ৫৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের যোগান দিয়েছে তৈরি পোশাক খাত। এ খাতে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ৬দশমিক ৬৭ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ০৭ শতাংশ আয় কম হয়েছে এবার।
এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৫৫৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলার; যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ কম। উভেন পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৫০৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি কমেছে ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার কারণেই বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে (২০১৪ থেকে ২০১৮) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের দাম কমেছে ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। ইউরোপের বাজারে কমেছে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
জুলাই মাসে ভিয়েতনামে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ শতাংশ। ভারতে ৭ শতাংশ; পাকিস্তানে ৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। পরের মাস আগস্টে ভিয়েতনামে ৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ আর পাকিস্তানে দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৪৬ শতাংশ কমে যায়।
এ সব তথ্যই বলছে প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তান থেকেও আমরা খারাপ করছি, বলেন রুবানা হক। খুবই খারাপ অবস্থা। আমাদের সব অর্ডার ভিয়েতনাম-ভারতে চলে যাচ্ছে। সরকারের পলিসি সাপোর্ট ছাড়া এই খারাপ অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পারব না।
খুব চিন্তার মধ্যে আছি আমরা। ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ৫৯টি কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ২৯ হাজার ৭০০ জন শ্রমিক বেকার হয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের পলিসি সাপোর্ট দরকার। সে কারণেই আমি বড় আকারের বৈঠকের কথা বলছি। যেখানে সার্বিক পরিস্থিতি আলোচনা করে আমাদের পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি পথ বা পরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। এবং খুব দ্রুত এটা করতে হবে।
রুবানা হক বলেন, ভারত সরকার তাদের দেশের পণ্য রপ্তানির উপর ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এজন্য তারা ৫০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে। পাকিস্তান ৭ শতাংশ সহায়তা দিচ্ছে।আর বাংলাদেশে ১ শতাংশ সহায়তা নিয়েই নানান কথা হয়।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই মুহুর্তে যেটা করতে হবে সেটা হল ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার মান কমাতে হবে। যে কাজটি আমাদের কমপিটিটর দেশ চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম প্রতিনিয়ত করছে। আমাদেরও এখন সেই কাজটি করতে হবে।
তিনি বলেন, মূলত: দুটি কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমছে। প্রথমত: ইউরোপের দেশগুলো আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার। সেখানে এক ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। সে কারণে সে দেশগুলোর মানুষ খরচ কমিয়ে দিয়েছে। পোশাকসহ অন্যান্য জিনিস কম কিনছে। তবে আমেরিকার অর্থনীতি চাঙ্গার কারণে সেখানকার বাজারে বাংলাদেশ ভালো করছে।
দ্বিতীয় কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, আমাদের নিজস্ব সমস্যা আছে। সেটা হচ্ছে, উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ায়নি বায়াররা। প্রতিযোগী দেশগুলো বাজার ধরে রাখতে তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে; আমরা সেটাও করিনি। সবমিলিয়েই আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
আমেরিকা-চীনের বাণিজ্য যদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে জানিয়ে আহসান মনসুর বলেন, আমেরিকার বাজারে আমাদের রপ্তানি বাড়লেও অন্য দেশগুলো থেকে পিছিয়ে পড়ছি। এতোদিন ইউএস মার্কেটে আমরা ৩/৪ নম্বরে ছিলাম। এখন ৭ নম্বরে নেমে এসছি।
সবমিলিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চীন, ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর মতো আমাদের টাকার অবম্যূল্যায়নের পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে জুলাই-অক্টোবর সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। চা রপ্তানি বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।
তবে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৮ দশমিক ০৭ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৫ ৪ শতাংশ।
এই চার মাসে শাক-সবজি রপ্তানি বেড়েছে ২৬৩ শতাংশ। হ্যান্ডিক্যাফট রপ্তানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। তবে তামাক রপ্তানি কমেছে ৮ শতাংশ।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৮২ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫.৫০ বিলিয়ন) ডলার।