যুদ্ধাপরাধ: পুঠিয়ার রাজাকার সামাদের ফাঁসির রায়
একাত্তরে রাজশাহীর পুঠিয়ায় হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার দায়ে মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁর ফাঁসির রায় এসেছে যুদ্ধাপরাধ আদালতে
বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মঙ্গলবার আসামির উপস্থিতিতে এ মামলার রায় ঘোষণা করে।
এক সময়ের মুসলিম লিগ কর্মী সামাদ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে পুঠিয়ার গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত হন বলে উঠে এসেছে এ মামলার বিচারে।
১৭৪ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত বলেছে, আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা চারটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিটি অভিযোগেই তাকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
যে ধরনের অপরাধ আসামি আব্দুস সামাদ ঘটিয়েছেন, তাতে তাকে ‘এনিমি অব দ্য অল হিউম্যান রাইটস’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় রায়ে।
তবে এই রায়ে সন্তুষ্ট নন জানিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, তারা সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
“সাঁওতাল পল্লীর লোকদের সাথে আসামির বাবার জমি সংক্রান্ত বিরোধ ছিল। ১৯৬৪ সালে জমি বিনিময় করে সাঁওতালরা এসেছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার বছরে এসে সাঁওতালরা বিনিময়কৃত ৫০ একর জমি ফেরত চাইলে আসামি, আসামির বাবা এবং এলাকার লোকদের সাথে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে আসামির বাবাও মারা যান। আমি মনে করি এটা জমি সংক্রান্ত বিরোধের মামলা।”
নিয়ম অনুযায়ী, রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন ৬২ বছর বয়সী আব্দুস সামাদ।
অন্যদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আসামি যে অপরাধ করেছে, সন্দেহাতীতভাবে সেসব অপরাধ আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।
“রায়ে আদালত বলেছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আসামি অপরাধ সংগঠনের সময় এতটাই নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন যে, মৃত্যুদণ্ডের চাইতে বেশি কোনো শাস্তি থাকলে সেটিই তার জন্য প্রযোজ্য হত।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৩৯টি মামলার ৯৭ আসামির মধ্যে ছয়জন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ৮৯ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৬২ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।
মামলা বৃত্তান্তপ্রসিকিউশনের তদন্ত দল ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর যখন এ মামলার তদন্ত শুরু করে, তখন আসামি করা হয়েছিল ৬ জনকে। কিন্তু তদন্ত চলার সময়ই বাকি পাঁচ আসামির মৃত্যু হলে একমাত্র আসমি হিসেবে থাকেন মো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁ।
তদন্ত চলার মধ্যেই নাশকতার একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় সামাদকে। পরে ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি তাকে যুদ্ধাপরাধের এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনলেও যাচাই-বাছাই শেষে চারটি অভিযোগের ভিত্তিতে আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করে প্রসিকিউশন।
তার ওপর শুনানি করে আদালত গতবছর ৯ সেপ্টেম্বর আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এরপর ১০ অক্টোবর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ।
প্রসিকিউশনের পক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৫ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। তাদের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা বাদে ১৪ জনই চাক্ষুস সাক্ষী। আসামিপক্ষ কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
সাক্ষীদের জেরা শেষে গত ৪ থেকে ৮ জুলাই দুই পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা ও জাহিদ ইমাম এবং আসামি পক্ষে আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ন শুনানিতে অংশ নেন।
যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ৮ জুলাই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে ট্রাইব্যুনাল।
কে এই সামাদমো. আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁর বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়ার ত্রিমোহিনী বাজারের কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামে। ১৯৭১ সালে দেশে যখন স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়, সময় তার বয়স ২০ বছরের মত।
প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, সামাদের পূর্বপুরুষ এদেশে এসেছিলেন ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন।
এ মামলার অভিযোগপত্রের বিবরণ অনুযায়ী, চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা সামাদ এক সময় মুসলিম লিগ করলেও একাত্তরে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে ভেড়েন এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ নিয়ে পুঠিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান এবং চারজন সাঁতালসহ ১৫ জনকে হত্যা, ২১ জনকে নির্যাতন, ৮ থেকে ১০টি বাড়িঘরে লুণ্ঠন এবং ৫০ থেকে ৬০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগে অংশ নেন বলে অভিযোগ করা হয় মামলায়।
অভিযোগ ১: একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের দমদমা, সুখদেবপুর, বাঁশবাড়ি ও গতিয়া গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।
অভিযোগ ২: একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার গণ্ডগোহালী, চকপলাশী, বৈরাগীবাজার ও বাঁশবাড়ি গ্রামে ছয়জনকে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।
অভিযোগ ৩: একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের পশ্চিমবাগ গ্রামের সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যা।
অভিযোগ ৪: একাত্তরের ২০ এপ্রিল পুঠিয়ার ভালুকগাছী ইউনিয়নের ঢোকরাকুল গ্রামে একজনকে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।
মানবতাবিরোধী এই চার ঘটনাতেই আসামি আব্দুস সামাদ (মুসা) ওরফে ফিরোজ খাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।