যুদ্ধাপরাধী কায়সারের ফাঁসি আপিলেও বহাল
মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধের দায়ে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদণ্ডের যে রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দিয়েছিল, সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়েও তা বহাল রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এই সিদ্ধান্তের ফলে জাতীয় পার্টির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ফাঁসিকাষ্ঠেই যেতে হবে।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারকের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার মাত্র এক মিনিটে রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেয়। কায়সারের আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হলেও দুটি অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এবং একটি অভিযোগে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে।
এই বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা এবং বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান।
একাত্তরের মুসলিম লীগ নেতা কায়সার ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর একজন বিশ্বস্ত সহযোগী। ‘কায়সার বাহিনী’ নামে দল গড়ে তিনি যেসব যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছেন, সেজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের মানুষ তাকে একজন কুখ্যাত ব্যক্তি হিসাবেই চেনে।
সেই কায়সারই স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের আমলে হয়ে যান বিএনপির লোক, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় জাতীয় পার্টির; দল বদলের কৌশলে প্রতিমন্ত্রীও বনে যান।
২০১৪ সলের ২৩ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেছিল, “কায়সার এতোটাই নগ্নভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিলেন যে নিজের গ্রামের নারীদের ভোগের জন্য পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠিত হননি।”
সেই রয়ে সাতটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কায়সারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, যার মধ্যে দুই নারীকে ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে। এই দুই বীরাঙ্গনার মধ্যে একজন এবং তার গর্ভে জন্ম নেওয়া এক যুদ্ধশিশু এ মামলায় সাক্ষ্যও দেন। আর একটি ঘটনায় ছিল নির্বিচারে হত্যার অভিযোগ।
এছাড়া অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যায় সংশ্লিষ্টতার চারটি অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং তিনটি অভিযোগে আরও ২২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
আপিলের রায়ে তিনটি অভিযোগে কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। তিনটি অভিযোগে তার প্রাণদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কায়সারকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ তাকে খালাস দিয়েছে।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর আপিলে আসা এটি নবম মামলা, যার ওপর চূড়ান্ত রায় হলো।
নিয়ম অনুযায়ী আসামি এই রায় পর্যালোচনার আবেদন করতে পারবেন। তাতে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত না বদলালে আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন। তাতেও তিনি বিফল হলে সরকার সাজা কার্যকরের পদক্ষেপ নেবে।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের আইনজীবী এসএম শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ের অনুলিপি পেলে ভাল মত দেখে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে।”
অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “এই রায়ে আমাদের দেশে ধর্ষণে সহযোগিতা করার দায়ে প্রথম কোনো আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। ওই অভিযোগের যে ভিকটিম, সে নিজে কোর্টে এসে সাক্ষ্য দিয়েছে এবং তার মেয়েও আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছে দুর্দশার কথা।
“এই ১২ নম্বর অভিযোগটিতে চার বিচারপতিই একমত হয়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন। আর ৫ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।”
২০১৩ সালের ১৫ মে ট্রাইব্যুনাল কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে সেই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় মুসলিম লীগের এই সাবেক নেতাকে। বয়স ও স্বাস্থ্যগত পরিস্থিতি বিবেচনায় ট্রাইব্যুনালে তাকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়।
যুদ্ধাপরাধের ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে পরের বছর ২ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ কায়সারের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। সেই বিচার শেষে ২০১৪ সলের ২৩ ডিসেম্বর তার মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে।
সেই রায়ের পর একাত্তরের এই যুদ্ধাপরাধীকে কারাগারে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার আপিল বিভাগের রায়ের সময় তিনি ছিলেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে।
ফাঁসিকাষ্ঠের পথেনিয়ম অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেটি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল। সেই মৃত্যু পরোয়ানা ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ।
পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ। তবে রিভিউ যে আপিলের সমকক্ষ হবে না, তা যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়েই স্পষ্ট করা হয়েছে।
রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
যা বলেছিল ট্রাইব্যুনাল
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সলের ২৩ ডিসেম্বর সৈয়দ কায়সারের মামলার রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনাল অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে কোনো যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ ছিল সেটাই প্রথম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিকে ‘দমনের অস্ত্র হিসাবে’ ধর্ষণের ব্যবহার এবং সেই পাশবিকতার শিকার নারীদের দুর্দশার কথা বার বার উঠে আসে এই রায়ে।
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত আড়াই লাখ বীরাঙ্গনা ও তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুদের ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করে ‘জাতীয় বীর’ হিসাবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন- তারা আমাদেরই মা, আমাদেরই বোন। আমরা আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না।”
বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও রায়ে আশা প্রকাশ করা হয়।
ক্ষতিপূরণ স্কিম চালুর পাশাপাশি বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং যারা ইতোমধ্যে মারা গেছেন, তাদের মরণোত্তর সম্মান জানিয়ে স্বজনদের শোক ও দুর্দশা লাঘবের ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে বলে ট্রাইব্যুনাল।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “সমাজ ও জাতিকে আরো মনে রাখতে হবে যে, বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, মুক্তিযোদ্ধারা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সমাজ ও জাতির কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই এখনো সেই আত্মত্যাগের জন্য মানসিক ক্ষত বয়ে চলেছেন বেঁচে থাকা বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা। ধর্ষণের শিকার এসব নারীদেরও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেওয়া উচিৎ, তাদের অব্যক্ত বেদনাকে আর অবহেলা করা যায় না।”
ট্রাইব্যুনাল বলে, সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠন বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে আদালত আশা করে।
“শুধু ধর্ষণের শিকার নারীদের ক্ষত দূর করার জন্য নয়, বরং আমাদের সমাজ ও জাতির ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্যও এটি করা প্রয়োজন। তাই, তাদের মানসিক-সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য বিস্তৃত ও সুশৃঙ্খল মনোযোগ ও ব্যবস্থার ওপর জোর দিচ্ছি আমরা।”
ডিগবাজ যুদ্ধাপরাধীহবিগঞ্জের মাধবপুরের ইটাখোলা গ্রামের সৈয়দ সঈদউদ্দিন ও বেগম হামিদা বানুর ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার ওরফে মো. কায়সার ওরফে সৈয়দ কায়সার ওরফে এসএম কায়সারের জন্ম ১৯৪০ সালের ১৯ জুন।
তার বাবা সৈয়দ সঈদউদ্দিন ১৯৬২ সালে সিলেট-৭ আসন থেকে কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএলএ নির্বাচিত হন। ওই বছরই মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন তার ছেলে কায়সার।
১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কায়সার মুসলিম লীগ সিলেট জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি পরাজিত হন।
১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ৫০০ থেকে ৭০০ ‘স্বাধীনতাবিরোধীকে’ নিয়ে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করেন এই মুসলিম লীগ নেতা। তিনি নিজে ছিলেন ওই বাহিনীর প্রধান।
তিনি যে সে সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দমন অভিযান চালিয়েছিলেন- সে বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের রায়েও উঠে আসে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার ঠিক আগে কায়সার পালিয়ে লন্ডনে চলে যান। দেশে ফেরেন ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর।
জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৮ সালে আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হন কায়সার। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন।
পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং হবিগঞ্জ বিএনপির সভাপতি হন। ১৯৮২ সালে তিনি বিএনপির শাহ আজিজুর রহমান অংশের যুগ্ম মহাসচিবও হন।
সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে কায়সার জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং হবিগঞ্জ শাখার সভাপতির দায়িত্ব পান। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে আবারও দুই দফা তিনি সংসদ সদস্য হন। ওই সময় তাকে কৃষি প্রতিমন্ত্রীরও দায়িত্ব দেন এরশাদ।
এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন কায়সার। এক পর্যায়ে এরশাদের দল ছেড়ে তিনি যোগ দেন পিডিপিতে।
এই যুদ্ধাপরাধীর ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর ও সৈয়দ মোহাম্মদ গালিব দুজনেই বিতর্কিত গ্লোবাল অ্যাগ্রো ট্রেড কোম্পানির (গ্যাটকো) পরিচালক। দুর্নীতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার ডিপো পরিচালনার দায়িত্ব ওই কোম্পানিকে দেওয়ার এক মামলায় তাদের দুজনকেই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারাগারে যেতে হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও ওই মামলার আসামি।