যুক্তরাজ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশিরা?
নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা স্থানে করোনাভাইরাসের স্থায়ী ও অসম সংক্রমণ কীভাবে রোধ করা যায়? যুক্তরাজ্যে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি সম্প্রদায়ের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন থেকে এই প্রশ্নের কিছু উত্তর পাওয়া যায়।
২০২০ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সংক্রমণের পরিসংখ্যান বিবেচনায় দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলো করোনায় মৃত্যুর অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে এই ঝুঁকি সেখানকার বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
যুক্তরাজ্যের বর্ণ ও জাতিগত বৈষম্য বিষয়ক কমিশনের (সিআরইডি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি শুধু জাতিগত পরিচয়ের জন্য নয়, বরং সংক্রমণেরই ঝুঁকির ফল। তারা দেখতে পেয়েছে, জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন বৈষম্য ও অসুবিধার কারণে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
এ বিষয়ে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে মতামত জানিয়েছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের নৃবিদ্যার অধ্যাপক লরা বিয়ার। তার মতে, স্বাস্থ্যগত বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি সম্প্রদায়ের লোকজন অল্প বয়সেই দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যার শিকার হন। তারা মূলত খুচরা পণ্য বিক্রি, পরিবহন ও সেবা খাতে কাজ করেন, যা করোনাভাইরাসের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অস্থায়ী কর্মচারী বা ব্যবসার মালিক হওয়ার অর্থ- তারা অসুস্থতার সময় সবৈতনিক ছুটি বা বাড়িতে থাকার সুযোগ কম পাচ্ছেন।
বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি সম্প্রদায়ের লোকজন সাধারণত পরিবারের বয়স্ক ও কম বয়সী সদস্যদের সামাজিক সহায়তা করেন এবং এক বাড়িতেই জনাকীর্ণভাবে বসবাস করেন। এটি কর্মস্থল ও স্কুল থেকে পরিবারের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ায় এবং কেউ অসুস্থ হলেও তাকে আইসোলেশনে রাখা কঠিন হয়ে যায়।
লরা বিয়ারের মতে, জাতিগত এবং ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এসব সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত দুর্নাম ও বর্ণবৈষম্যের শিকার হচ্ছে। স্বাস্থ্যের ওপর এর ফলাফল খুব মারাত্মক হতে পারে এবং এটি সেবাগ্রহণেও বাধা সৃষ্টি করে।
এসব সমস্যা মরামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন ধরন ছড়ানো সত্ত্বেও খুচরা পণ্য বিক্রি ও সেবাখাত আগের তুলনায় বেশি সময় খোলা রাখা হচ্ছে। অথচ এসব কর্মজীবীর সুরক্ষায় কেন্দ্রীয়ভাবে কোনও ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।
তাছাড়া, আত্মকর্মসংস্থান ও ক্ষুদ্র পারিবারিক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তদের যথেষ্ট পরিমাণে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়নি। সরকারি স্কিমে ঋণ দেয়া হচ্ছে, যার ঝুঁকি ক্ষুদ্র ও অনিশ্চিত ব্যবসায়ীরা নিতে চাইবেন না এবং আত্মকর্মসংস্থানকারীদের বেলায় আগের বছর দেয়া করের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সহায়তা দেয়া হচ্ছে, যা কোনও পরিবারের প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে নগণ্য হতে পারে।
আর পরিবারের কথা বললে, যৌথ পরিবারগুলো সংক্রমণ থেকে কীভাবে নিরাপদ থাকবে সে বিষয়ে কোনও দিকনির্দেশনাই দেয়া হয়নি। তাছাড়া, ঈদ ও রমজান ঘিরে সরকারি যে পদক্ষেপ নেয়া হয়, তাতেও সাহায্যপ্রার্থী গোষ্ঠীগুলোর কেবল দুর্নাম ও ক্ষমতাহানিই বাড়ছে।
এ অধ্যাপক মনে করেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে নেয়া শিক্ষা পরবর্তী প্রাদুর্ভাবগুলো মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে প্রথম নির্দেশনা হবে, ভবিষ্যতের পদক্ষেপগুলোতে যেকোনও ধরনের বিলম্ব বা বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তার মতে, একটি সতর্ক নীতিই হতে পারে সুষ্ঠু নীতি।
ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় লরার পরামর্শ, করোনা-সুরক্ষিত কর্মস্থান নিশ্চিতে আইনি বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে পেশাগত সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো যায়। কোনও কর্মী অসুস্থ হলে সতর্কতাস্বরূপ সবৈতনিক ছুটি দিতে হবে, সেক্ষেত্রে ন্যূনতম বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘সেলফ-আইসোলেশন পেমেন্ট’ দেয়া যেতে পারে। কর্মস্থলে টিকাগ্রহণের ব্যবস্থা করা অথবা টিকাগ্রহণের জন্যে সবৈতনিক ছুটি দিতে হবে। রাজস্ব বিভাগ ঋণ বা কর-সম্পর্কিত সহায়তার বদলে অনুদান দিলে তা সংকট মোকাবিলায় ভালো কাজ করবে।
পরিবারগুলোকে ঘরোয়া কাজকর্মে সুরক্ষাবিধি মেনে চলা শেখাতে হবে। জাতীয় এবং স্থানীয় জনসেবা বিভাগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সংকটের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে দুর্নাম ও বর্ণবাদকে স্বীকৃতি দেয়া দরকার। স্থানীয় কার্যক্রম পরিচালনার সময় নির্দিষ্ট কোনও জনগোষ্ঠী এবং তাদের পরিবারগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়।
সবশেষ, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পরামর্শ এবং সহযোগিতা ছাড়া এসব উদ্যোগের কোনোটিই সফল করা সম্ভব নয়। এর জন্য সমাজে পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং সবার জন্য সমান স্বাস্থ্য-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।