মোংলা বন্দরের জ্বালানি তেল ষ্টেশন দীর্ঘ ১৬ বছরেও চালু করা যায়নি
সফিকুল ইসলাম শান্ত, মোংলা
মোংলা বন্দরের জ্বালানি তেল ষ্টেশন দীর্ঘ ১৬ বছরে চালু করা যায়নি। এর ফলে এখানে আগত বিভিন্ন সমুদ্রগামি জাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহে বিড়ম্বনার শেষ থাকছে না। এতে করে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীসহ বন্দর ব্যবহারকারীরা। ইতিমধ্যে জ্বালানী তেল ষ্টেশনের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও এখন পর্যন্ত এটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সময় দিলেই এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বন্দর প্রতিষ্ঠার ৬৯ বছর পর সরকারের জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের আওতায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এ কেন্দ্রে মজুত ও সংরক্ষন করা হবে সকল প্রকার জ্বালানী তেল। আর এখান থেকে দেশী-বিদেশী বাণিজ্যিক জাহাজসহ সকল প্রকার নৌযানে সরবরাহ করা হবে জ্বালীনী তেল। এছাড়া দেশের দক্ষিণ উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠান পাবে জ্বালানী তেলের সুবিধা। এ চালু হওয়ার পর বানিজ্যিক জাহাজ সমূহের জ্বালানী তেলের সংকট নিয়ে চলমান বিড়ম্বনা দূর হওয়াসহ দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে জ্বালানি তেলের সংকট অনেকটাই পূরণ হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সূত্র জানায়, চালনা পোট নামে ১৯৫০ সালে মোংলা সমুদ্র বন্দরের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতেই আমদানি-রপ্তানি বানিজ্য সুবিধার পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বানিজ্যিক জাহাজ সমূহের জন্য জ্বালানী তেল সরবরাহের (বাঙ্কারিং) কোন সুবিধা না থাকায় এ বন্দরে জ্বালানী তেল ডিপো স্থাপনের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে। শিপিং কোম্পানি ও শিপিং এজেন্ট সহ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন মহলে এ দাবির মুখে বাংলাদেশ প্রেট্রেলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ২০০৩ সালের ফেব্রæয়ারী মাসে মোংলা বন্দর এলাকায় ২১নং প্লটে ২৫ একর জমি বরাদ্দ নেয়।
বরাদ্দকৃত জমিতে সরকার এক লাখ মেট্রিক টনের দ্বিতীয় তেল স্থাপনা “মোংলা অয়েল ইনস্টলেশন” নির্মাণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে, সে পরিপ্রেক্ষিতে বিপিসি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ডিপিপি ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে অনুমোদিত হয়। এরপর বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভুমি বরাদ্দ নেয়ার পর টানা বছরের পর বছর সময় ধরে বাংলাদেশ পেট্রেলিয়াম করপোরেশন জায়গা ফাঁকা পড়ে থাকে।
পরবর্তীতে শুধুমাত্র একটি সাইন বোড ঝুলিয়ে রাখা হয় এখানে। নানা জটিলতায় আটকে পড়ে এ প্রকল্পের কাজ। আর এতে হতাশা দেখা দেয় বন্দর ব্যবহারকারি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। ইতিমধ্যে ৫/৬ জন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ প্রদান করা হলেও কাজের কোন প্রকার অগ্রগতি হয়নি।
পরবর্তীতে ২০১২ সালে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে প্রকৌশলী মোঃ মোছাদ্দেক হোসেন (উপ-মহাব্যবস্থাপক, পদ্মা অয়েল কোম্পানী লিমিটেড)কে নিয়োগদানের ফলে প্রকল্পের কাজের গতি ফিরে পায়। তার নিয়োগের পর ২০১২ সালের ৯ জুলাই সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদিত হয়। অনুমোদনের পর হতে প্রকল্প এলাকায় ভূমি উন্নয়নসহ মূল কাজ ১ লাখ মেট্রিক টন ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন ১৪ টি পেট্রোলিয়াম স্টোরেজ ট্যাংক ও অটোগেজিং সিস্টেম স্থাপন, অত্যাধুনিক ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম, সাবস্টেশন নির্মাণ ও ৪টি মেরিন লোডিং আর্ম ডলফিন অয়েল জেটি নির্মানসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।
অপর সূত্র জানায়, চট্টগ্রামস্থ পতেঙ্গাতে তিনটি তেল বিপনন কোম্পানীর (পদ্মা/মেঘনা/যমুনা) মেইন ইনস্টলেশন অবস্থিত। বর্তমানে দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেল এর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়াতে তেল মজুদাগার বাড়ানোর প্রয়োজন। স্থান সংকুলানের অভাবে চট্টগ্রামস্থ মেইন ইনস্টলেশনে মজুদাগার বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। চট্টগ্রামস্থ পতেঙ্গার মেইন ইনস্টলেশন হতে তেল আনয়ন করে এ অঞ্চলের চাহিদা পূরণ করা হয়।
তাছাড়া চট্টগ্রামস্থ পতেঙ্গার মেইন ইনস্টলেশনে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দিলে অথবা প্রয়োজন হলে বিদেশ হতে আমদানীকৃত পেট্রোলিয়াম পন্য মোংলা অয়েল ইনস্টলেশন স্থাপনায় গ্রহন করে তা বিকল্প ইনস্টলেশন হিসেবে সারা দেশে জ্বালানি তেলের স্বাভাবিক সরবরাহ বজায় রাখতে সক্ষম হবে। এ প্রেক্ষিতে মোংলা অয়েল ইনস্টলেশন দ্বিতীয় তেল স্থাপনা হিসেবে ডিপিপি অনুমোদিত হয়েছে।
মোংলা অয়েল ইনস্টলেশন হতে কোস্টাল ট্যাংকারের মাধ্যমে দৌলতপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল ডিপোসমূহ ও পাওয়ার প্লান্টসহ এ অঞ্চলের শিল্প প্রতিষ্ঠানে জ্বালানি তেল সরবরাহ সহজতর হবে। ট্যাংক লরির মাধ্যমে বাগেরহাট, পিরোজপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ জেলাসমূহে তেল সরবরাহ সহজতর হবে। তাছাড়াও বর্তমানে নির্মাণাধীন রেল লাইন চালু হলে রেল ওয়াগানের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা যাবে। ফলে দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে জ্বালানি তেলের চাহিদা বহুলাংশে পূরণ করা সম্ভব। তদুপরি মোংলা বন্দরে আসা ফরেন শীপে বাংকারিং এর মাধ্যমে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা যাবে। এছাড়াও সহজে জ্বালানি তেল প্রাপ্তির ফলে মোংলা বন্দরে আগত দেশী বিদেশী জাহাজ, ইপিজেড, বেজাসহ মোংলা বন্দর শিল্প এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে লাভবান হবে ও তাদের কার্যক্রমে ব্যাপক গতিশীলতার সঞ্চার করা যাবে।
নব নির্মিত এ জ্বালানী তেল ডিপো প্রসঙ্গে মোংলা বন্দর ব্যবহারকারী ও শিপিং ব্যবসায়ী এইচ এম দুলাল জানান, বিশ্বের সকল বন্দরে বাঙ্কারিং সুবিধা থাকলেও আঞ্চলিকার শিকার হয়ে এতদিন এ বন্দরে তেল ডিপো না থাকায় এটি অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হওয়াসহ মাদার ভ্যাসেল (জাহাজ) কোম্পানি, শিপিং এজেন্ট সহ সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসায়ীকে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। জ্বালানী তেলের অভাবে অনেক বানিজ্যিক জাহাজ এ বন্দরে দিনের পর দিন আটকে থাকার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া মাদার ভ্যাসেলের জন্য চট্রগ্রাম বন্দর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জ্বালানী তেল সংগ্রহ করতে হয়েছে। এতে যেমন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় তেমনি সময় অপচয় সহ নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। তিনি আরো জানান, নতুন এ তেল ডিপোটি স্থাপিত হওয়ায় এ বন্দরের জন্য গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখবে।
মোংলা ওয়েল ইনস্টলেশন (বিপিসি) প্রকল্প কর্মকর্তা মোসাদ্দেক হোসেন জানান, এ প্রকল্পটির মেয়াদ আগামি জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই এর যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন যে কোন সময় এটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি আরো জানান, এটি চালু হলে জ্বালানী তেল সরবরাহ নিশ্চিতসহ মোংলা বন্দরে বানিজ্যিক জাহাজের আগমন ও কাজের গতি বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে দক্ষিণ-উত্তরাঞ্চলের শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ঘটবে। এ জ্বালানী তেল স্টেশন থেকে দেশের সর্বত্র সকল প্রকার জ্বালানী তেল সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এর চেয়ারম্যান সামছুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জ্বালানী মন্ত্রনালয় থেকে এ তেল ষ্টেশনটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য প্রধান মন্ত্রীর কাছে দিন ও সময় চাওয়া হয়েছে। তিনি সময় দিলেই এটি উদ্বোধন করা হবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর এ কে এম ফারুক হাসান (বিএন) জানান, তেল ডিপোটি স্থাপিত হওয়ায় বাণিজ্যিক জাহাজে তেল সরবরাহ নিশ্চিত হবে। দূর হবে দীর্ঘদিনের চলমান ভোগান্তি। জ্বালানী তেলের অভাবে বানিজ্যিক জাহাজ সমূহকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এ সমস্যার সমাধান হবে এবং বিদেশীদের কাছে এ বন্দরের গুরুত্ব বাড়বে। সকল প্রকার জ্বালানী তেল সরবরাহ নিশ্চিত হওয়াসহ বন্দরে জাহাজের আগমন বৃদ্ধি ও আমদানী রপ্তানি পন্যের চাপ বৃদ্ধিসহ বাড়বে কাজের গতি।