November 27, 2024
আন্তর্জাতিক

‘মিরর পজিশনে’ চীন-ভারত, বিরল বৈঠক শনিবার

মহামারি করোনা ভাইরাসে প্রায় বিধ্বস্ত বিশ্ব। মোকাবিলায় কোনোকিছুই পুরোপুরি কাজে আসছে না। সমরশক্তির তো প্রশ্নই উঠে না। এসবের পরও যেন একে অপরকে ছেড়ে কথা বলছে না চীন-ভারত। প্রায় যুদ্ধ পরিস্থিতি! প্রতিবেশী দেশ দুটির সীমান্ত ঘেরাও সমরশক্তির দাপটে। সামরিক পরিভাষায় যাকে বলে ‘মিরর পজিশন’।

বেশ কয়েক দিন ধরেই চীন ভারতকে যা দেখাচ্ছে, ভারতও চীনকে ঠিক সেটাই দেখাতে চাইছে। লাদাখে এলএসি (প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা) বরাবর চীন কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন করে রেখেছে। অস্ত্রশস্ত্রও রেখেছে। আবার ভারতও ততটাই মোতায়েন করে দিয়েছে। ঠিক যেন একে অপরের মুখের সামনে আয়না ধরা হয়েছে।

এরইমধ্যে আবার গত ২৬ মে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে পরিস্থিতি যেন আরও ঘোলাটে করে দেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, যেকোনো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। দেশকে সুরক্ষা দিতে সবরকমভাবে প্রস্তুতি থাকা চাই।

সবমিলে পরিস্থিতি এমন, ঢিল এলে পাটকেল ফিরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত। কিন্তু আলোচনা বন্ধ হয়নি দু’দেশের। জানা গেছে, শনিবার (০৬ জুন) কোর কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠক বসতে চলেছে। সীমান্ত বিবাদ নিয়ে এই স্তরের বৈঠক ভারত-চীনের মধ্যে বিরল। অর্থাৎ আলোচনায় সমস্যা মিটতে পারে সে সম্ভাবনাও আছে বেশ।

আনন্দবাজারে সম্পাদকীয়তে ভারতের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা যুদ্ধ বিশারদ কর্নেল সৌমিত্র রায় বলেছেন, সবকিছুরও পরও বিরল বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত-চীন। কিন্তু কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, চীন মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। চমকে দিয়ে ‘হানাদারি’ চালাতে পারে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। সুতরাং পাল্টা হানাদারির জন্যও কিন্তু প্রস্তুত থাকতে হবে ভারতীয় বাহিনীকে।

ভারত এবং চীনের সীমা যেখানে মিশেছে, অরুণাচল থেকে লাদাখ পর্যন্ত সেই বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়েই নানা এলাকায় সীমান্ত নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এলএসি বলে ভারত যে রেখাকে মানে, অনেক জায়গাতেই চীন সেই রেখাকে মানে না! এলএসি আসলে কোনটা, তা নিয়ে ভারত এবং চীনের ধারণায় ফারাক রয়েছে বলে অনেকে উল্লেখ করেন।

কিন্তু এই ‘ধারণা’ শব্দটাই আপত্তিকর। এলএসি আসলে কোনটা, তা কারও ধারণার ওপরে নির্ভর করে না। সেই ৬০-এর দশক থেকেই ঐতিহাসিক দলিল এবং ভৌগোলিক যুক্তি তুলে ধরে ভারত অত্যন্ত স্পষ্টভাবে চীনকে দেখিয়েছে ভারতের এলাকা কতদূর পর্যন্ত। কিন্তু এলএসির অবস্থান সম্পর্কে চীনের বক্তব্যে কোনো ধারাবাহিকতা নেই। তাদের দাবি বার বার বদলে যায়, বলেন অব. কর্নেল সৌমিত্র রায়।

তিনি বলেন, এলএসি-তে বিবাদ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) বা আদর্শ আচরণবিধি তৈরি করে রেখেছে দু’দেশ মিলেই। ভারত যে রেখাকে এলএসি হিসেবে মানে, সব জায়গায় যে সেই রেখাকে চীন স্বীকৃতি দিতে চায় না, সে কথা আগেই বলেছি। ফলে কখনও চীনের টহলদার বাহিনী ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়ে। কখনও চীন অভিযোগ করে, ভারতীয় বাহিনী ঢুকে পড়েছে চীনা এলাকায়। এই অবস্থ!

সৌমিত্র রায় বলেন, শনিবার কোর কমান্ডার স্তরের বৈঠক বসছে ভারত ও চীনের মধ্যে। লাদাখের চুসুলে এই বৈঠক হবে। লেহ জেলার মধ্যে পড়ে চুসুল। অবস্থান প্যাংগং-এর দক্ষিণ দিকে এবং একেবারে এলএসি-র গায়ে। যে বৈঠক সেখানে হবে শনিবার, তা কিন্তু ভারত-চীনের মধ্যে বিরল। সীমান্ত বিরোধে বার বার স্থানীয় স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যেই বৈঠক হয়। বড় সংঘাতের ক্ষেত্রে খুব বেশি হলে ডিভিশনাল কমান্ডার অর্থাৎ মেজর জেনারেল র‌্যাংকের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসেন। এই প্রথম কোর কমান্ডার স্তরের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসছেন। অর্থাৎ ট্যাকটিক্যাল লেভেল মিটিং নয়, তার চেয়ে অনেক বড় স্তরের মিটিংয়ে বসছে দু’দেশের সামরিক বাহিনী।

তিনি আরও বলেন, এই বৈঠকের আয়োজন বুঝিয়ে দিচ্ছে, এলএসি-তে কোনো পক্ষই এখন একটা পুরোদস্তুর যুদ্ধ চায় না। চীন হয়তো এ বার বড়সড় সংঘাতই চেয়েছিল। তার কারণ কী কী, সেসব আগেও ব্যাখ্যা করেছি। কিন্তু চালটা বোধহয় উল্টো ফল দিয়েছে। তাই পরিকল্পনা বদলাতে হচ্ছে চীনকে।

তিনি বলছেন, এমনিতেই করোনা সংক্রমণের আবহে বিশ্বের বড় বড় শক্তি চীনকে সংশয়ের চোখে দেখতে শুরু করেছে। আমেরিকার সঙ্গে চলতে থাকা শুল্কযুদ্ধ ঘিরেও আন্তর্জাতিক মহলের একটা প্রভাবশালী অংশ চীনের বিরুদ্ধে। সেসবের মধ্যেই ভারতের সঙ্গে নিজেদের সীমান্ত বিবাদকে চীন বড়সড় উদ্বেগের জায়গায় নিয়ে যাওয়ায় কূটনৈতিক স্তরে চীনবিরোধী আবহ আরও গাঢ় হয়েছে।

সৌমিত্র রায় বলেন, আবার বলছি, চীন একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। চীনের আচরণে ধারাবাহিকতা খুব কম। কোর কমান্ডার স্তরের বৈঠকের প্রস্তুতি চলছে। কূটনৈতিক স্তরেও হয়তো কথাবার্তা হতে পারে এর পরে। কিন্তু এসব আলোচনার প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই কোনো সেক্টরে চমকে দিয়ে চীন হানাদারি চালাতে পারে। ভারতীয় এলাকায় ঢুকে শিবির তৈরির চেষ্টা করতে পারে। তাই ভারতকে কিন্তু সেসবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

তিনি এও বলেন, যত দূর খবর পাচ্ছি, সেসব প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছে ভারতীয় সেনা। এলএসি-তে যে পরিমাণ বাহিনী ইতোমধ্যেই মোতায়েন করা হয়েছে, যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র এবং সরঞ্জাম পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা চীনের চেয়ে বেশি হতে পারে, কম নয়। প্রয়োজন হলে দৌলত বেগ ওল্ডির বিমানঘাঁটিতে থাকা সি-১৩০-জে সুপার হারকিউলিসের মতো বিরাট সামরিক বিমান যে যখন তখন নামতে পারে, তা-ও সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে ভারত।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *